চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সাদা পোশাকে বাংলাদেশের দৈন্যদশা আরও একবার ফুটে উঠলো। দুই ইনিংসেই বিবর্ণ ব্যাটিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইনিংস ও ২৭৩ রানে হারলো বাংলাদেশ। নিজেদের উইকেট ও কন্ডিশনে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয়ে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হতে হলো নাজমুল হোসেন শান্তর দলকে। এই হারে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকার তলানিতে নেমেছে তারা।
আসলে বাংলাদেশের এমন হতশ্রী পারফরম্যান্সের কোনও ব্যাখ্যা নেই। এই ব্যর্থতার শেষ কোথায়, সেটিও কারও জানা নেই। ম্যাচের পর ম্যাচ কেবল ক্রিকেটার ও কোচিং স্টাফরা নানা অজুহাতই দেখাচ্ছেন। ব্যর্থতার পর ক্রিকেটাররা বলেন, এই শিক্ষা তারা সামনে কাজে লাগবেন, কিন্তু মাঠের খেলায় ওই ‘শিক্ষা সফরের’ কোনও প্রভাব দেখা যায় না। কোচিং স্টাফদের ব্যাখ্যাও চোখ কপালে তোলার মতো। ২৫ বছর ধরে টেস্ট খেলা দলটাকে আরও সময় দেওয়ার দাবি তাদের। কথার কায়দায় পরিস্থিতি না ভেবে এড়িয়ে গেলেও বাজে পারফরম্যান্স যেন কোনোভাবেই এড়াতে পারছে না বাংলাদেশ দল।
পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট সিরিজ ২-০ ব্যবধানে জিতে ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশ। এরপর ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চারটি টেস্টে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল অবিশ্বাস্যরকম বাজে। বিশেষ করে দলের টপ অর্ডার ব্যাটারদের দায়িত্বহীনতাই এমন ব্যর্থতার মূল কারণ। বাংলাদেশ দলের ব্যাটাররা দুইবার ব্যাটিং করেও ইনিংস হার এড়াতে পারেননি। একদিনেই দুইবার অলআউট হয়ে বড় ব্যবধানে ম্যাচ হেরেছেন শান্ত-মুশফিকরা।
অথচ টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে এবং খেলোয়াড়দের আরও অনুপ্রাণিত করতে বিসিবির নানা পদক্ষেপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, খেলোয়াড়দের ম্যাচ ফি বাড়ানো। ক্রিকেটের ম্যাচ ফি ৮ লাখ টাকা হয়েছে। বিশাল অঙ্কের এই পারিশ্রমিক পেলেও খেলার মানে রয়েছে বিশাল ঘাটতি। অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়ার পর ক্রিকেটাররা নিজেদের মেলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন, ব্যর্থতা মেনে নিয়ে উন্নতি তো দূরে থাকা, হয়ে উঠছেন কথার রাজা! যেখানে সামান্য সুযোগ সুবিধা পাওয়া নারী ফুটবল দলে একের পর এক ইতিহাস রচনা করছেন। দুই মাস ধরে বেতন না পেয়েও যারা ভিনদেশে দেশের পতাকা উড়াতে তীব্র লড়াই করেছেন! হিমালয়ের দেশে উড়িয়েছেন জাতীয় পতাকা। এইসব কিছুই শান্ত-মুশফিকদের মাঝে অনুপস্থিত! নিবেদনের ঘাটতির কারণেই একের পর এক ব্যর্থতা উগরে দিচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর কেটে গেছে লম্বা সময়। কিন্তু এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের উন্নতি হয়নি কিছুই! মাঝে মধ্যে কঠিন প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে বাহবা কুড়ালেও আদতে এই ফরম্যাটে বাংলাদেশ এখনও ‘শিশুই’। ২৫তম বছরে এসে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ হার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলো এই ফরম্যাটে কোথায় বাংলাদেশের অবস্থান? ব্যাটারদের দায়িত্বজ্ঞানহীন সব শট, ফিল্ডারদের পিচ্ছিল হাতে দুটি ম্যাচেই বাংলাদেশ দলকে বড় ব্যবধানে হারতে হয়েছে। এমন হারের পরও ক্রিকেটারদের মধ্যে কোনও অপরাধবোধের ছিটেফোঁটাও পাওয়া যায় না!
ঢাকায় হারের পর প্রত্যাশা করা হচ্ছিল, চট্টগ্রামের ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রোটিয়াদের বিপক্ষে তিনটি দিনই চরম হতাশায় পার করেছে শান্তরা। ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে সফরকারী ব্যাটাররা দাপট দেখালেও বাংলাদেশের ব্যাটাররা ছিলেন অসহায়। প্রোটিয়ারা তিন সেঞ্চুরিতে ৬ উইকেটে ৫৭৫ রান করেছে। অথচ একই উইকেটে বাংলাদেশ খাবি খেয়েছে।
বুধবার ম্যাচের দ্বিতীয় দিন ৩৮ রানে ৪ উইকেটে হারানোর পরই বোঝা যাচ্ছিল ইনিংস হার চোখ রাঙাচ্ছে দলকে। তৃতীয় দিনে আরও ভয়ঙ্কর অবস্থায় পড়ে স্বাগতিকরা। দিনের শুরুতেই কাগিসো রাবাদার তোপে শেষ নাজমুল হোসেন শান্ত (৯)। প্রথম ইনিংসে যা একটু লড়াই করেন মুমিনুল। ৬ রান নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামা এই ব্যাটার তাইজুলকে সঙ্গে নিয়ে ১০৩ রানের জুটি গড়েন। তাইজুল ৩০ রানে আউট হলেও মুমিনুল থামেন ৮২ রানে। মুমিনুল ফিরলে কার্যত শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস। ১৫৯ রানে থামার পর ফলোঅনে পড়া বাংলাদেশকে ফের ব্যাটিংয়ে পাঠায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও একই পরিণতি। ইনিংস হার এড়ানো তো দূরে থাক, বাংলাদেশ দল দ্বিতীয় ইনিংসে আরও কম রানে আউট হন। প্রথম ইনিংসে তো তবুও মুমিনুল কিছু রান করেছেন, দ্বিতীয় ইনিংসে সেটি কেউই পারেননি। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ দলের ইনিংস ১৪৩ রানে থামতেই সফরকারীরা জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হয়। ভারত সফরে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর এবার ঘরের একই পরিণতি দেখলো শান্তরা।
৫ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের ব্যাটিং লাইনআপকে তছনছ করে দিয়েছিলেন রাবাদা। দ্বিতীয় ইনিংসে চললো প্রোটিয়াদের ঘূর্ণিজাদু। দুই স্পিনার সেনুরান মুথুস্যামি ও মহারাজ মিলে তুলে নেন ৯ উইকেট। তার মধ্যে মহারাজের শিকার ৫ উইকেট। বাংলাদেশের ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান আসে হাসান মাহমুদের ব্যাট থেকে। ওয়ানডে মেজাজে ব্যাটিং করে ৩০ বলে ৩৮ রান করেন এই পেসার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৪ রান আসে অধিনায়ক শান্তর ব্যাট থেকে। ২৯ রান আসে অভিষিক্ত উইকেটকিপার ব্যাটার মাহিদুল ইসলাম অঙ্কনের ব্যাট থেকে।
ক্রিকেটে প্রতিটি দলেরই একটু একটু করে উন্নতি হচ্ছে। আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে খুব বেশি দিন হয়নি। সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলটি সেমিফাইনাল খেলেছে। সব ফরম্যাটেই প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করেন রশিদ খানরা। তাদের ছোটরাও এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হয়। কিন্তু লম্বা সময় ধরে ক্রিকেট খেলা বাংলাদেশ কেবল পেছন পথে হাঁটছে। উন্নতির ছিটেফোঁটাও নেই তাদের পারফরম্যান্সে। তবুও মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে আসেন, হতাশার ভুলে গিয়ে প্রত্যাশার গল্প শোনান। কিন্তু সেইসব গল্প গল্পই থেকে যায়, বাস্তবে ধরা দেয় না!