গত কয়েক বছর ধরেই স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে চলছেন সাকিব আল হাসান। ক্রিকেট বোর্ড যেন সাকিবের মর্জি মতোই সব করছে! সর্বশেষ ঘটনাকেই উদাহরণ ধরা যেতে পারে। শুক্রবার দলের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা উড়াল দেওয়ার কথা থাকলেও মানসিক অবসাদের কারণ দেখিয়ে ঠিকই ছুটি আদায় করে নিয়েছেন। তার কথা মেনে নিয়ে ৫৩ দিনের বিশ্রাম দিয়েছে বিসিবিও। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিশ্রাম নেওয়ার এই ‘সিদ্ধান্ত’ তার ওপরই বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে!
এমনিতেই আইপিএল খেলার সুযোগ হারিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে তিনি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে ছুটি নিতে গিয়ে ঢাকা লিগে খেলার সুযোগও হারিয়েছেন। তেমনটা না হলে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে সরে গিয়েও হয়তো ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগটা পেয়ে যেতেন। কিন্তু এখন একূল-ওকূল সব হারিয়ে আর্থিকভাবে বড় ক্ষতির মুখে বাঁহাতি অলরাউন্ডার।
সাকিবের সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল। বরিশাল ফরচুনের হয়ে ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ের পাশাপাশি অধিনায়কত্বেও সাকিব নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছিলেন। কিন্তু দুই দিনের আইপিএলের নিলামেই ছন্দপতন ঘটে তার। ওই দুই দিনে আইপিএলের কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজিই সাকিবকে দলে নিতে আগ্রহ দেখায়নি। দুই কোটি রুপির ভিত্তিমূল্যের সাকিব থেকে যান অবিক্রীত। নিলামে দল না পাওয়ার প্রভাব সাকিবের পারফরম্যান্সেও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। নিলামের পর বিপিএলে কোয়ালিফায়ার ও ফাইনাল ম্যাচসহ আফগানিস্তানের বিপক্ষে তিন ওয়ানডে ও দুই টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। কিন্তু সব ম্যাচেই নিজের ছায়া হয়ে ছিলেন সাকিব।
জাতীয় দলের টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজন তো স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলেন, আইপিএলে দল না পাওয়ার প্রভাব পড়েছে সাকিবের মনে, ‘‘শুধু সাকিব না, আমিও প্রত্যাশা করছিলাম সে ভালো পারিশ্রমিকে আইপিএলে বিক্রি হবে। শুধু সাকিবের জন্য না, বাংলাদেশের জন্যও লজ্জার দেশের সেরা ক্রিকেটার আইপিএলের মতো জায়গায় খেলতে পারছেন না। যদিও সে বলেছে, ‘না সুজন ভাই, আমি ব্যথা পাইনি।’ তবে মনের কোনও একটা ব্যথা থাকতে পারে।’’
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের পোস্টারবয় নিয়মিতই আইপিএলে খেলে আসছেন। যে ফর্মে ছিলেন, স্বাভাবিকভাবে বড় অঙ্কেই তাকে দলে ভিড়ানোর কথা ছিল ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর। শেষ পর্যন্ত দল না পাওয়াতে সাকিবের কমপক্ষে দুই কোটি রুপির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সাকিব আবার সেসব ক্ষতি ব্যক্তিগত চুক্তির মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করছেন। এই মুহূর্তে সাকিব একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির শুটিংয়েই দুবাইতে অবস্থান করছেন। বিপিএলের ফাইনালের আগের দিনও ব্যক্তিগত ফটোশুটে হোটেলের বাইরে গিয়েছিলেন তিনি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ চলাকালীনও টিম ম্যানেজমেন্টের অনুমতি নিয়ে দুই ঘণ্টার জন্য বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে অংশ নিয়েছিলেন। এই সবকিছুই হয়তো আইপিএলের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ারই আয়োজন।
সাকিব যে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ থেকে ছুটি নিয়েছেন, সেটিও হয়তো এই আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কারণেই! কেননা, দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই ফরম্যাটের ম্যাচ খেলে সাকিবের আয় হতো সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকার মতো। প্রতি ওয়ানডেতে ম্যাচ ফি ৩ লাখ করে ৯ লাখ এবং দুই টেস্টের ম্যাচ ফি ১২ লাখ। টি/এ, ডি/এ মিলিয়ে সেই অংক গিয়ে দাঁড়াতো ২৫ লাখের মতো। দক্ষিণ আফ্রিকায় না গিয়ে ব্যক্তিগত চুক্তিগুলো ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলতে পারলে সাকিবের আয়টা আরও বেশি হয়ে যেত। মোহামেডানের সঙ্গে চলতি মৌসুমে এক কোটি টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছেনে বলে ক্লাব সূত্রে জানা গেছে। এক কোটি টাকার সঙ্গে বিজ্ঞাপন ও ফটোশুট চালিয়ে যেতে পারলে সাকিবের জন্য আইপিএলের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে ফেলা সম্ভব হতো। স্বল্প সময়ে, স্বল্প পরিশ্রমে সাকিব হয়তো সেটাই চেয়েছিলেন।
কিন্তু বুমেরাং হয়ে যাওয়া সিদ্ধান্তে সাকিব এখন নিজের জালেই আটকে গেছেন। বিসিবি তাকে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর তো বটেই, বাড়তি আরও ১৫ দিনের ‘বিশ্রাম’ দিয়েছে। ফলে আগামী ১৫ এপ্রিল দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ শেষ হলেও সাকিব বিশ্রাম কাটানোর সুযোগ পাবেন ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। আর এই ‘ছুটির’ গ্যাঁড়াকলে পড়ে সাকিব মিস করবেন মোহামেডানের হয়ে আসন্ন ঢাকা প্রিমিয়ার লিগও। আর এই লিগ মিস হওয়া মানে সাকিবের আর্থিক ক্ষতিটা আরও বেড়ে যাওয়া।
বিসিবির এক পরিচালক মনে করেন, দক্ষিণ আফ্রিকা না যাওয়ার পেছনে সাকিবের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে ফেলার একটা কারণ থাকতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘আমার কোনও সন্দেহ নেই সাকিব ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই দেশের হয়ে খেলতে চাইছে না। আইপিএলে না গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাকিবের মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়ে না খেলে কোনোভাবে যদি ওই ক্ষতিটা পুষিয়ে ফেলা যায়, সেই ভাবনাও সাকিবের থাকতে পারে। পুরো বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত মতামত।’
সাকিব গত কয়েক বছর ধরেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ২০১৯ সালে ঢাকা ডায়নামাইটসের সোয়া দুই কোটি টাকার প্রস্তাব ছেড়ে সাড়ে তিন কোটিতে চুক্তি করেছিলেন রংপুর রাইডার্সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিসিবি পুরনো দলগুলোর সঙ্গে নতুন করে চুক্তি সম্পাদন করেনি। সেবার বিশেষ বিপিএল আয়োজন করেছিল বিসিবি। এই কারণে সাকিব পেয়েছেন মাত্র ৫০ লাখ টাকার মতো। ওখানে সাকিবের ক্ষতি হয় প্রায় তিন কোটি টাকা। ওই বছরই গ্রামীণফোনের সঙ্গে তিন কোটি টাকার বিজ্ঞাপন চুক্তি করে বিপাকে পড়েন যান তিনি। কেননা, বোর্ডের সঙ্গে তখন রবি’র চুক্তিবদ্ধ ছিল।
এরপর আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় এক বছর ক্রিকেটার বাইরে থাকার কারণে সাকিবের সঙ্গে বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিই বাতিল হয়ে গেছে। ওই এক বছর একটি টাকাও বেতন পাননি। নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০২০ সালে আইপিএলও খেলতে পারেননি বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার। পাশাপাশি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও সাকিবের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে।
তবে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর আগের মতো কোটি কোটি টাকার প্রস্তাব নিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বেশি অফার আসতে থাকে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আসর থেকে। করোনাকালীন সময়ে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) থেকেই ৩ কোটি ২০ লাখ রুপিতে বিক্রি হয়েছেন। শ্রীলঙ্কা সিরিজ বাদ দিয়ে সাকিব আইপিএলে অংশও নিয়েছিলেন। তবে পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) এবং ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (সিপিএল) খেলার সুযোগ পাননি তিনি। মোহামেডানের হয়ে খেলার কারণে যেতে পারেননি পিএসএলে। অন্যদিকে ঘরের মাঠেও অস্ট্রেলিয়ার সিরিজ থাকায় তাকে অনাপত্তিপত্র দেয়নি বিসিবি।