জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেছেন, রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তনের এক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ভাগ্যবিড়ম্বিত রাষ্ট্রের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের সব অংশের মানুষের কার্যকর মালিকানা নিশ্চিত করে জনগণের অভিপ্রায়ের ‘প্রজাতন্ত্র’ নির্মাণ করতে হবে।
রবিবার (২৭ এপ্রিল) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে (জাতীয় সংসদের এলডি হলে) আলোচনায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জেএসডি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার ও নির্বাচনের সমন্বিত রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে।
৫টি সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রণীত ৫টি স্প্রেডশিটে মোট ১৬৬টি প্রস্তাবের ওপর মতামত চাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে জেএসডির পক্ষ থেকে ১২১টি প্রস্তাবের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ, ১৭টির সঙ্গে ভিন্নমত এবং ২৮টির সঙ্গে আংশিক ঐকমত্য হয়েছে।
এই ১৬৬ প্রস্তাবের মধ্যে ৬৮টি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে, ১৪টি নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে এবং ৮৪টি সংবিধান সংস্কারসভা ও আইনসভা নির্বাচন একইসঙ্গে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়ে জেএসডি মতামত দিয়েছে। এছাড়া নতুন করে ১০ এপ্রিলকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ঘোষণা ও রাষ্ট্রপতির শপথ—প্রধান বিচারপতি কর্তৃক পরিচালনার করার জন্য জেএসডির পক্ষ থেকে দাবি উত্থাপন করা হয়।
১. সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত দেশের নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা করে জেএসডি বলেছে—বাংলাদেশের নাম ৫৩ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অনাবশ্যক নাম পরিবর্তনের কারণে বিতর্কের জন্ম দেবে, যা পরিহার করা জরুরি। ২. সংবিধানের প্রস্তাবনায় একাত্তরের চেতনা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের নির্দেশনা, ‘৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনসহ অগ্নিঝরা মার্চের ঘটনাবলি উল্লেখ এবং ‘২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ থাকার প্রস্তাব দিয়েছে। ৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদসহ অন্যান্য জাতিসত্তার স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাবে বলা হয়েছে—বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্রের পত্তন হয়েছে, হঠাৎ করে বাঙালি জাতিসত্তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে—এ ধরনের পদক্ষেপ আত্মঘাতী। ৪. জেএসডি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার—এই ত্রয়ী আদর্শকে সংবিধানের দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচনার প্রস্তাব দিয়েছে এবং রাষ্ট্রের চার মূলনীতিকে অপরিবর্তিত রাখা বাঞ্ছনীয় মনে করলেও গণতন্ত্রকে আরও সম্প্রসারিত করে অংশীদারত্বের গণতন্ত্র প্রবর্তনের দাবি করেছে। ৫. সংসদের উচ্চকক্ষের ২০০ আসনে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবীদের অদলীয় ভিত্তিতে (ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্বতিতে) প্রতিনিধিত্ব প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। ৬. উচ্চকক্ষ হতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন ও তার মেয়াদ তিন মাস করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ৭. বিদ্যমান সব বিভাগকে প্রদেশে উন্নীতকরণ এবং ফেডারেল সরকার পদ্ধতির সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৮. রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৯. দুবারের অধিক প্রধানমন্ত্রী পদে কোনও ব্যক্তি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। ১০. স্বশাসিত উপজেলা, পৌরসভা এবং মেট্রোপলিটন সরকারসহ শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
জেএসডির পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, স্থায়ী কমিটির সদস্য তানিয়া রব, ছানোয়ার হোসেন তালুকদার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজ মিয়া, অ্যাডভোকেট কেএম জাবির, মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন, কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী এবং দলের উপদেষ্টা ডা. হেলালুজ্জামান আহমেদ প্রমুখ।
আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ছাড়া সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা থেকে সংস্কার কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষাকে পরিপূর্ণতা দিতে রাষ্ট্র সংস্কার দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত ৫৩ বছর ধরে আমরা এমন শাসন ব্যবস্থা দেখেছি, যা ফ্যাসিবাদ তৈরি করতে পারে। এই শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।’
সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এই কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়।
উল্লেখ্য, প্রথম পর্যায়ে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ওপর রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট মতামত জানাতে অনুরোধ করে সুপারিশগুলোর স্প্রেডশিট আকারে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়। এ পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে কমিশন মতামত পেয়েছে।
সংস্কার কমিশনগুলোর করা সুপারিশ চূড়ান্ত করতে গত ২০ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ইতোমধ্যে ১৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা শেষ করেছে কমিশন।