চলমান সংকটের সমাধান হিসেবে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপিসহ দেশের ডান, বাম-প্রগতিশীল ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবিও করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। দলগুলোর দাবি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দেশকে শান্তির পথে নিয়ে আসতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সোমবার (৫ আগস্ট) ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। এদিন রাতে পাঠানো বিবৃতিতে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, তথা ছাত্র-জনতার এক দফা আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি সফল করুন এবং একইসঙ্গে নিজ নিজ এলাকায়ও আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখুন।’
বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের এই নির্মম হামলা, দমন নিপীড়নের’ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘দেশব্যাপী গণজাগরণের মধ্য দিয়ে জনগণ গণঅভ্যুত্থানের পথে যে যাত্রা শুরু করেছেন; হত্যা-দমন-নিপীড়ন চালিয়ে তা আর ব্যর্থ করা যাবে না।’
প্রসঙ্গত, রবিবার সকালে কীভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে, এ নিয়ে একটি প্রস্তাব দেয় ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ নামে একটি সংগঠন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এই রূপরেখা তুলে ধরেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আনু মুহাম্মদ। তিনি সরকারের অবিলম্বে পদত্যাগ দাবি করেন।
আনু মুহাম্মদ উল্লেখ করেন, অবিলম্বে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মূল শক্তিগুলোর সম্মতিক্রমে, নাগরিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষক, বিচারপতি, আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের অংশীজনদের নিয়ে একটি জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-শ্রেণির অন্তর্ভুক্তিমূলক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। এই সরকারের সদস্য নির্বাচনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। এই সরকারের কাছে শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করবে।
রবিবার বিকালে এক বছরের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয় এবি পার্টি। দলটির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু কারাগারে। সংবাদ সম্মেলনে দলটির পক্ষ থেকে সাত দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়।
দলটির দাবি চলমান আন্দোলনে সক্রিয় সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে অনূর্ধ্ব ২০ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন। যার মেয়াদ এক বছরের বেশি হতে পারবে না।
জুলাইয়ে প্রাণহানি থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হত্যা, গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার জন্য গ্রহণযোগ্য তদন্ত কমিশন ও স্বতন্ত্র ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবিও জানিয়েছে এবি পার্টি।
রবিবার এক বিবৃতিতে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারে ছাত্রসহ সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ও গুরুতর আহত করা দেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার পরিপন্থি ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’
‘নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে মনে রাখতে হবে, মানুষের প্রাণের মূল্য সম্পদ বা স্থাপনার চেয়েও অনেক বেশি’, উল্লেখ করেন তিনি।
রবিবার পুরানা পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সরকারকে পদত্যাগ করে ‘জাতীয় বিপর্যয়’ থেকে দেশকে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতারা।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সমন্বয়ক এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সভাপতি রাগীব নাঈম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি দিলীপ রায়, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি ছায়েদুল হক নিশান, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা এবং বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) তাওফিকা প্রিয়া এক যৌথ বিবৃতিতে ‘আন্দোলনে যুক্ত শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের সমন্বয়ে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন গণতান্ত্রিক সরকার’ গঠনের দাবি জানিয়েছেন।
ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা দিয়েছে ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’। দুপুর ১২টায় রাজধানীর তোপখানা রোডস্থ মেহেরবা প্লাজায় দলের প্রধান কার্যালয়ে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই রূপরেখা উত্থাপন করা হয়। দলটির দাবি, ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে সংবিধানের ৫৭ (১)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণের ১০ দিনের মধ্যে আন্দোলনকারী সব শক্তির সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতে সর্বজন গ্রহণযোগ্য কিছু ব্যক্তির নামের তালিকা প্রস্তুত করবেন। সংক্ষিপ্ত তালিকার মধ্য থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মনোনীত করবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দেবেন।’
সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে সদ্য নিষিদ্ধ জামায়াতও। দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি মাওলানা এটিএম মাছুম বলেছেন, ‘দেশের সর্বস্তরের জনগণকে ছাত্রদের ঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, রবিবার সারা দেশে চলমান আন্দোলনের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীসহ অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিহত ও আহতের সংখ্যা নিরূপণ করেনি কোনও কর্তৃপক্ষ।
ছাত্র-জনতার এক দফার ডাকে সবাই ঢাকা চলুন শীর্ষক বিবৃতিতে হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বলেন, ‘‘আমাদের দেশের বীর ছাত্র-জনতা এক দফার ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি দিয়েছে। এর সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে দল-মত নির্বিশেষে সবাই আগামীকাল ঢাকা চলুন।’’
রাত সোয়া ৯টার দিকে এই বিবৃতির কথা বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেন হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ৫ আগস্টের দেশব্যাপী গণমিছিল প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির নেতা আহমদ আব্দুল কাইয়ূম গণমাধ্যমকে এ কথা জানান।
এক বিবৃতিতে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, ‘রক্ত ঝরিয়ে, নির্যাতন করে কোনও গণ-অভ্যুত্থান ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সরকারকে বাঁচতে হলে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।’
রবিবার বিকালে একটি বিক্ষোভ মিছিল করেছে ইসলামী আন্দোলন। মিছিল শেষে দলের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম বলেন, ‘রাজপথে যেহেতু নারী-পুরুষ, ছাত্র, অভিভাবক, চিকিৎসক, আইনজীবী, আলেম-ওলামা, ত্বলাবা, নায়ক-গায়কসহ সব স্তরের মানুষ নেমে এসেছেন, শেখ হাসিনার পতনই হবে এর একমাত্র সমাধান।’
তিনি বলেন, ‘জনতার রুদ্ররোষ শেখ হাসিনা বুঝতে চেষ্টা করুন। ছাত্র-জনতার একটিই দাবি, তা হলো খুনি হাসিনার পদত্যাগ। অন্যথায় জনগণ ঘরে ফিরে যাবে না।’
এক বিবৃতিতে অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, ‘নতুন জাতীয় বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। আমাদের পূর্ণ সমর্থন আপনাদের সঙ্গে আছে। তবে সশরীরে অংশগ্রহণ করে আপনাদের এই বিশাল আত্মত্যাগ ও অর্জনকে বিতর্কিত করতে চাই না। এই সফলতা আপনাদের ও সাধারণ মানুষের।’
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে সোমবার (৫ আগস্ট) ‘মার্চ টু ঢাকা’ শীর্ষক কর্মসূচি ডাকা হয়েছে।