আমলাদের কর্মপরিধি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সমালোচনাকে সরকারের সঙ্গে আমলাদের দূরত্ব তৈরির অপচেষ্টা হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। তারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন দলটির অভ্যন্তরে নেতাদের মধ্যে এমন আলোচনা রয়েছে। আমলাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় না জড়াতে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা রয়েছে।
দলটির সিনিয়র নেতাদের দাবি, সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আমলাদের কার্যক্রমের পরিধি কী, কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে অযথা ইস্যু বানানো এই মুহূর্তে ঠিক হবে না।
সম্প্রতি বাজেট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ সংসদে সরকারের কর্মকাণ্ডে আমলাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা তুলে বক্তব্য রাখেন। এই বক্তব্যের সূত্র ধরেই আমলা-সরকার দূরত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয় দলের ভেতর।
সরকারের এক সিনিয়র মন্ত্রীর মতে, আমলাদের প্রাধান্য পাওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। করোনাকালীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকায় রাজবীতিবিদরা ভিজিবল (দৃশ্যমান) নন। তাই আমলাদের প্রাধান্য পাওয়ার কথা আসছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী শুক্রবার (২ জুলাই) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশ পরিচালনায় সরকারের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। নেতাদের ভাবা উচিত সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে। তবে তিনি এও বলেন, ‘কারও গণতান্ত্রিক বক্তব্য নিয়ে কথা বলতে চাই না।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না বলে জানান।
জানতে চাইলে সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শুক্রবার (২ জুলাই) বলেন, ‘আমলাদের কর্মপরিধি নিয়ে এ মুহূর্তে মন্তব্য করতে চাই না। বিষয়টিকে ইস্যু করাও ঠিক হবে না। এ নিয়ে যদি বলতেই হয় পরে বলবো।’
উল্লেখ্য, করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি ত্রাণ সহায়তায় সমন্বয় কাজে জেলাভিত্তিক সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে সারাদেশে গৃহহীন মানুষদের গৃহনির্মাণ ও উপহার দেওয়ার কাজেও সম্পৃক্ত আমলারা। এসব কাজে দলীয় নেতা, সংসদ সদস্য কাউকে সম্পৃক্ত রাখা হয়নি। এ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ভেতর অসন্তোষ রয়েছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোতে রাজনীতিবিদদের যুক্ত না করায় জনগণের প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয় বলে মনে করেন কেউ কেউ। এতে ইমেজ সংকটে পড়তে হয় বলেও ধারণা তাদের।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘দেশের মানুষের দুর্যোগে রাজনীতিবিদরাই কাজ করে। জনগণ জনপ্রতিনিধিদেরকেই পায়। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ হচ্ছে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা। জনগণের দুর্যোগে, বিপদে-আপদে পাশে থাকার সুযোগ তাদের কম।’
হানিফ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস, সামাজিক মুক্তি ও দুর্যোগের দিকে তাকালে দেখা যায় রাজনীতিবিদরাই পাশে থাকেন। জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বই হচ্ছে জনগণের ভালোমন্দ দেখা। এ দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তাদের পালন করার সুযোগ নেই।’
তিনি দাবি করেন, ‘হঠাৎ জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হলে আমরা মনে করি জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। জনপ্রতিনিধিদের মধ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।’
তিনি বলেন, ‘একজন সংসদ সদস্য অবশ্যই পদমর্যাদায় সচিবদের উপরে। এখন সংসদ সদস্যদেরকে কীভাবে তারা সম্মান দিচ্ছে বা দিচ্ছে না সেটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ঢালাওভাবে বলার সুযোগ নেই। রাষ্ট্র আমলানির্ভরতার দিকে গেলে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নষ্ট হয়।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, ‘ত্রাণ সহায়তায় আমলাদের ওপর সমন্বয়ের দায়িত্ব সরকারের কৌশলের একটি অংশ। মন্ত্রিসভায় অনেক জুনিয়র সদস্য রয়েছেন। তাদের ওপর এ দায়িত্ব দেওয়া হলে স্থানীয় এমপিদের সমন্বয় করা সহজ হতো না।’
মির্জা আজম দাবি করেন, ‘সরকারি কর্মকাণ্ডে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া মানে কোনোভাবেই তাদের লাইমলাইটে নিয়ে আসা নয়। এতে রাজনীতিবিদদেরও অসম্মান হয় না।’
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল বলেন, ‘আমি মনে করি আমলারা তাদের যেটুকু কাজ সেটাই করছে। সরকারের সিনিয়র এ মন্ত্রী আরও বলেন, করোনার কারণে রাজনীতি না থাকায় মিছিল-মিটিং হয় না। সভা-সমাবেশ এবং সম্মেলনও নেই। এ কারণে আমলাদের প্রাধান্য বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।’