চলমান শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ‘প্রত্যয়’ ঠেকাও কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয় পার্টিসহ দেশের বিরোধী দলগুলো। দলগুলোর এই সমর্থন আজ শনিবারও (৬ জুলাই) অব্যাহত ছিল। কোনও কোনও দলের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে ‘আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের’।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীল ও নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, শ্রেণিগত আন্দোলনে সব সময়ই রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পেশাজীবীদের আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক রূপ নেয়।
বিএনপির ক্ষমতাকালে সচিবালয়ে ‘জনতার মঞ্চ’ তৎকালীন বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়। এর আগে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ফারাক্কার আন্দোলনে সহযোগিতা ছিল জিয়াউর রহমান সরকারের।
আলাপে তারা উল্লেখ করেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ‘হেফাজতে ইসলাম’, ‘গণজাগরণ মঞ্চ’সহ একাধিক আন্দোলন মোকাবিলা করেছে। এরমধ্যে ‘সড়ক আন্দোলন’, ‘কোটাবিরোধী আন্দোলন’ উল্লেখযোগ্য।
তাদের দাবি, ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ হোক বা ‘হেফাজত’--কোনও ক্ষেত্রেই বিরোধী দল সুযোগ নিতে পারেনি। এমনকি ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আহ্বানও সাড়া পায়নি। সবই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে গেছে।
তবে এক রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীলের ভাষ্য, ‘সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা ছাত্রদের আন্দোলনে বিএনপিসহ অন্য দলগুলো সমর্থন দিলেও দুই শ্রেণির প্রত্যাশাগত মিল নেই। যে কারণে সমর্থন জানালেও আদতে তা রাজনৈতিক চিত্র পায় মাত্র।’
শনিবার বিকালে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি এখন শিক্ষকদের আন্দোলনের ওপর ভর করবে। আবার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোটা আন্দোলনের ওপর ভর করবে।’
এদিন সকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনকে যৌক্তিক আখ্যা দিয়ে তাতে সমর্থন জানান। একইসঙ্গে জাতীয় পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলনেও সমর্থন জানিয়ে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান তিনি।
বিএনপির পক্ষ থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলন ফেসবুকে লাইভে প্রচার করা হচ্ছে দলের অফিসিয়াল পেজে। বিএনপির যুগপৎসঙ্গীরা আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দিয়েছে। গতকাল শুক্রবার গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি উভয় আন্দোলনে সমর্থন ব্যক্ত করেন।
তিনি সেখানে বলেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলনে বিরোধী দল কোনও ষড়যন্ত্র করছে না। আমরা পরিষ্কারভাবে ছাত্রদের আন্দোলনকে সমর্থন জানাই, শিক্ষকদের আন্দোলনকে সমর্থন জানাই।’
কোটা পদ্ধতি সংবিধানবিরোধী বলে মনে করেন বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের। আজ গাজীপুরে দলের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছে। আমাদের দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে কোটা পদ্ধতি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোটা পদ্ধতি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ এর ১,২,৩ এর সম্পূর্ণ পরিপন্থি। সংবিধান সংশোধন করে এটাকে বৈধ করতে পারবে না। মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত ২৯ এর ১,২,৩ ধারা পরিবর্তন করার ক্ষমতা সংবিধানে দেওয়া হয়নি।’
শনিবারও বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। ‘বৈষম্যমূলক কোটা পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে ৭১ পূর্ব পাকিস্তানি বৈষম্য বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে যাবে’ বলে রীতিমতো হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’র সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু।
শুক্রবার (৫ জুলাই) বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নৈতিক ও নীতিগত প্রতিশ্রুতি না থাকলে এসব সমর্থনে কিছু আসে যায় না, প্রকৃত অর্থে রাজনীতিও নষ্ট হয়।’
তার সন্দেহ, দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি, ভারতের সঙ্গে সমঝোতা-স্মারক সইয়ের বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়াটি ছিল, হতে পারে এই দুটি শ্রেণিগত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পিছিয়ে যেতে পারে।’
এক প্রতিবাদ বিবৃতিতে শনিবার বিকালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সহকারী মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি শেখ ফজলে বারী মাসউদ বলেন, ‘কোটা ব্যবস্থা বহাল রেখে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে মেধাহীনদের দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন কীভাবে?’
রাজনৈতিক দলগুলোর ‘সমর্থনের রাজনীতি’ বিষয়ে জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোটা প্রথার বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ন্যায্য। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের এবং গণতন্ত্র মঞ্চের ঐকান্তিক সমর্থন আছে। এটাই আমাদের দায়িত্ব।’
‘শিক্ষকদের আন্দোলনেও আমাদের নৈতিক সমর্থন আছে। তাদের ওপর জবরদস্তি করে একটি স্কিম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নৈতিক সমর্থনের জায়গা আছে’, বলেন সাইফুল হক।
তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে মানুষ এই দুটি শ্রেণিগত আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে। এটা স্বাধীনভাবে চলাই ভালো। রাজনৈতিক রঙ লাগলে বরং সমর্থনে প্রভাব ফেলতে পারে।’
বিরোধী দলের কর্মসূচির বিষয়ে সাইফুল হকের ভাষ্য, ‘আমাদের ইস্যুগুলো অন আছে। সরকারের পদত্যাগ, ডামি সরকার বাতিল করে নতুন নির্বাচনের বিষয়ে আমরা সবাই অটল আছি। নিশ্চিতভাবেই আমরা সাপ রেখে দড়ি নিয়ে টানাটানি করবো না।’
তিনি বলেন, ‘এসব ইস্যুর সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগ, দুর্নীতি, দ্রব্যমূলের নিয়ন্ত্রণ, মোদির সঙ্গে করা শেখ হাসিনার সমঝোতা-স্মারক সই বাতিলের আন্দোলনকে সামনে নেবো। এটাকে ভিন্নপথে নেওয়ার সুযোগ বা চিন্তা কোনোটিই নেই। পাশাপাশি শ্রেণিপেশার আন্দোলনে আমাদের নৈতিক সমর্থন থাকবে।’
সাইফুল হক বলেন, ‘আমি প্রত্যাশা করি, তারাও বুঝবেন (শ্রেণিপেশার মানুষেরা) ফ্যাসিবাদকে বিদায় না দিলে রাষ্ট্রের কোনও কিছুই ঠিক হবে না।’
আরও পড়ুন-
মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায় আপাতত বহাল
কোটা পুনর্বহাল: বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা শিক্ষার্থীদের
কোটা ও পেনশন স্কিম বাতিলের আন্দোলনে বিএনপির সমর্থন
‘কোটা-শিক্ষকদের আন্দোলনে ভর করবে বিএনপি’
কোটা বাতিলের দাবিতে আবারও শাহবাগ অবরোধ
‘সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল সংবিধানবিরোধী’
কোটা বাতিলের দাবিতে রাজপথে শিক্ষার্থীরা
কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ
কোটা বাতিলের দাবিতে মাঠে শিক্ষার্থীরা, বহাল চায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ: হাইকোর্ট