কলাবাগানে বাসায় ঢুকে দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করার পর পাঁচ খুনি লেক সার্কাসের ডলফিন গলি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। খবর পেয়ে কলাবাগান থানার টহল পুলিশের একটি দল কাকতালীয়ভাবে ঘটনাস্থলের দিকে ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। হত্যাকারীদের সঙ্গে ডলফিন গলির ৬০ নম্বর বাসার সামনে পুলিশের মুখোমুখি হয়ে যায়। হত্যাকারীরা পাঁচ থেকে ছয় জন একসঙ্গে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন। তাদের সবার বয়স ছিল কম, ২০ থেকে ২৫। তাদের দৌড় দেখে পুলিশের সন্দেহ হলে পুলিশ গাড়ি থামিয়ে তাদেরও থামতে বলে। তবে খুনিরা না থেমে উল্টো পুলিশের ওপর হামলা চালান। এ সময় দুজনকে ঝাপটে ধরে আটকানোর চেষ্টা করে পুলিশ। তারা চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়ে পালিয়ে যান। আহত হন উল্টো দুই পুলিশ কর্মকর্তা। এদিকে, খুনিদের পোলাপান মনে করেন, কলাবাগান থানার এসআই শামীম। তিনি বলেন, ‘আমাদের ধারণাই ছিল না, এই ‘পোলাপানে’র কাছে এত কিছু আছে।’
সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কলাবাগানে খুন হন ইউএসএআইডির কর্মকর্তা ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল অফিসার জুলহাজ মান্নান (৩৫) ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় (২৮)। নিহত জুলহাজ সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির খালাতো ভাই। জুলহাজ বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। ‘রূপবান’ নামে একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন তিনি। অন্যদিকে তনয় আশা ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করতেন। লোকনাট্য নামের একটি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
কলাবাগান থানার পুলিশ জানিয়েছে, ৩৫ নম্বর বাসায় হামলার ঘটনাটি কলাবাগন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পারেন। ওসি রাসেল স্কয়ারে টহলে থাকা উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামীম আহমেদকে ফোনে দ্রুত ওই বাসায় যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। এসআই শামীম তার টহল টিমসহ দ্রুত ডলফিন গলির মসজিদের পাশ দিয়ে পিকআপ নিয়ে প্রবেশ করেন। টহল পুলিশের দলটিতে এসআই শামীম ছাড়াও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মমতাহ উদ্দিন, কনস্টেবল আজগর আলী, কনস্টেবল নূর ইসলাম ও গাড়িচালক কনস্টেবল মজিবর ছিলেন।
আরও পড়তে পারেন: ঘাতকের নৃশংসতা
এদিকে, ওই বাসা থেকে বের হয়ে হত্যাকারীরা তেঁতুলগলি হয়ে ডলফিন গলির দিকে যান। ডলফিন গলির মাঝামাঝি ৬০ নম্বর রাশেদ মোশাররফের বাড়ির সামনে হত্যাকারীদের সঙ্গে পুলিশের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
কলাবাগান থানার এসআই শামীম আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওসি স্যারের ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ওখানে রওয়ানা হই। ডলফিন গলির মুখ দিয়ে ঢুকতেই একটি ছেলে আমাকে জানিয়েছিল কিছু পোলাপান তেঁতুলতলায় ঝামেলা করছে। এরপর আমরা গাড়ি নিয়ে সামনের দিকে আগাই। আমি গাড়ির সামনে চালকের পাশের আসনে বসা ছিলাম। আমাদের সামনের দিক দিয়ে ৫/৬ জন ‘পোলাপান’ একই টি-শার্ট পরে দৌড়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের গাড়ি তখনও রানিংয়ে। এরপর আমি আমার সঙ্গে সোর্সদের বলি, ওদের থামতে বলো। এএসআই মমতাজ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে একজনকে ঝাপটে ধরেন। গাড়িটা অল্প একটু দূরে গিয়ে থামে। আমি এবং অন্য পুলিশ সদস্যরাও নামেন। এ সময় ওই ছেলেটাকে উদ্ধার করতে অন্য একজন চাপাতি দিয়ে হামলা চালান। চাপাতির আঘাত মমতাজের কপালে লাগে। তিনি মাটিতে পড়ে যান। এ সময় আমি পিস্তল দিয়ে এক রাউন্ড গুলি করি। অন্য এক পুলিশ সদস্যও গুলি করেন। তারাও পাল্টা গুলি চালান। একজনকে পেছনে থেকে আবার ঝাপটে ধরি। তবে তাকেও রাখতে পারিনি। এ সময় ডলফিন গলির মাথায় থাকা মসজিদ দিয়ে মুসল্লিরা বের হচ্ছিলেন। তাই আমি পাবলিকের কারণে দ্বিতীয় বার ফায়ার করিনি।’
আরও পড়তে পারেন: দেশের একমাত্র গে ম্যাগাজিন ‘রূপবান’ কাহিনী
এসআই শামীম বলেন, ‘‘আমাদের ধারণাই ছিল না, এই ‘পোলাপানে’র কাছে এত কিছু আছে। পরে দেখেছি তাদের তিনজনের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। দুজনের কাছে ছিল চাপাতি।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, ‘ঘটনার সময় ডলফিন গলিতে কয়েকশ লোক ছিলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। নট এ সিঙ্গেল ম্যান। একজন মানুষও যদি এগিয়ে আসতেন, তাহলে আমরা অন্তত দুই তিনজনতে ধরে রাখতে পারতাম। কিন্তু কেউ সহযোগিতা করলেন না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।’ তিনি বলেন, ‘যখন আমার অফিসারের ওপর হামলা হয়েছে, তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন, তখন আমার অফিসারে জীবন রক্ষা করাও আমার দায়িত্ব। ওই সময় হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। আমি নিজেও গর্তে পড়েছি। কিন্তু লোকজন দাঁড়িয়ে দেখছেন। কেউ এগিয়ে আসেননি।’
ডলফিন গলিতে মঙ্গলবার বিকালে গিয়ে বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোর নামে একটি দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি সোমবার আসরের নামাজ একটু দেরি করে পড়ছিলেন। মাগরিবের আগে দোকানে বসেই আসরের নামাজ আদায় করেন। এরপর বসে ছিলেন। এসময় গেঞ্জিপরা এক তরুণ পিস্তল হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন। এরপর তিনি দোকানের নিচে বসে পড়েন। তিনি একবার গুলি শব্দ পেয়েছেন বলেও জানান।
/এমএনএইচ/