X
বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫
২৭ চৈত্র ১৪৩১

যেভাবে দুর্ধর্ষ জঙ্গি হয়ে উঠেছিল ঢাকার এক কিশোর

নুরুজ্জামান লাবু
০৭ অক্টোবর ২০২০, ০৯:০০আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০০:০৮


সাফফাত ইসলাম

বয়স সবে ১৭। ২০২০ সালে এসএসসি পাস করেছে। দেখলে মনেই হবে না এত অল্প বয়সেই সাফফাত ইসলাম নামের এই কিশোর হয়ে উঠেছিল দুর্ধর্ষ জঙ্গি। আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সবশেষ খবর তার ঠোঁটস্থ। পিস্তল থেকে সাব মেশিনগানসহ সব অস্ত্র ও এসব হাতিয়ার কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সবই জানে সে।

জিহাদ করতে মরিয়া সাফফাত নব্য জেএমবির একটি সেলের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিল। সেলের সদস্যদের কাছে সে পরিচিত ছিল একাধিক নামে। কেউ তাকে চিনতো আব্দুল্লাহ নামে। কেউবা উইলিয়াম, কুতুব উদ্দিন আইবেক, চেঙ্গিস খান, আলী ইবনে সুফিয়ান, আরকে খান, আল্প আরসালান কিংবা মেহমেদ চাগরী বেগ নামে।

মুসলিম বীরযোদ্ধাদের নামে নিজের পরিচয় দিতে পছন্দ করতো এই কিশোর। সিরিয়া বা আফগানিস্তানের খোরাসানে গিয়ে জিহাদ করার ইচ্ছা ছিল তার। এজন্য স্বেচ্ছায় ঘরও ছেড়েছিল। কিন্তু এর আগেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের হাতে এক সহযোগীসহ গ্রেফতার হয় এই কিশোর। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তার কথা শুনে চমকে উঠেছেন খোদ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাই।

ঢাকার একটি উচ্চ-মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবারে বেড়ে ওঠা এই কিশোর কীভাবে জঙ্গিবাদের দীক্ষা পেলো?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাফফাতকে জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলা ট্রিবিউন। আদালতে দেওয়া এই কিশোরের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সংগ্রহ করা হয়েছে। 

জানা গেছে, গত ৪ জুলাই কথিত হিজরতের নামে ঘর ছাড়ে সাফফাত। ইয়াছির আরাফাত শান্ত নামে এক সহযোগীসহ অবস্থান করে চাঁদপুরের একটি মারকাজে (আস্তানা)। প্রায় দেড় মাস পর সেখান থেকে ঢাকায় একটি বৈঠকের জন্য এলে ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় সদরঘাট এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে সিটিটিসি।

স্বজনরা বলছেন, সাফফাত এ বছর এলিফ্যান্ট রোডের বিসিএসআইআর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। এলিফ্যান্ট রোডে নিজেদের বাড়িতে বাবা-মা ও ছোটবোনের সঙ্গে থাকতো সে। ছোটবেলা থেকেই ইসলামিক নিয়মকানুন মেনে চলতো সাফফাত। খেলাধুলার চেয়ে ঘরে বসে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন চালাতে পছন্দ করতো বেশি। তেমন বন্ধুবান্ধব ছিল না। ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনই ছিল তার বন্ধু। স্বজনরা মনে করেন,  তার জন্য এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

একটি স্মার্টফোন, একটি ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট সংযোগই জঙ্গিবাদের অন্ধকার জগতে নিয়ে গিয়েছিল সাফফাতকে।


আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ছেলেটি এটাই উল্লেখ করেছে।

সিটিটিসি’র হাতে গ্রেফতারের পর পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে সাফফাত গত ২৩ আগস্ট মুখ্য মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরীর কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। 

১৭ বছরের এই কিশোর বলেছে, ‘আমি নিয়মিত টম অ্যান্ড জেরি কার্টুন দেখতাম। ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধ ও অস্ত্র ভালো লাগতো এবং এগুলোর প্রতি কৌতূহলী ছিলাম। আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র, যুদ্ধ-বিদ্রোহ আমার পছন্দের বিষয়। ফেসবুকে ইরাকের বোন ফাতেমার চিঠি ও নিউরো সায়েন্টিস্ট আফিয়া সিদ্দিকির চিঠি দেখার পর বুঝতে পারি আমেরিকাসহ ন্যাটো জোট মুসলিম বিশ্বের ওপর এবং মুসলিম নারীদের ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এমন অবস্থায় আমাদের উচিত ছিল পূর্বের ক্রুসেড নিধনের মতো তাদের কচুকাটা করা। সেই উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করতে থাকি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সমাজতন্ত্র, গোয়েন্দানীতি এবং যুদ্ধ কৌশলসহ মানসিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে থাকি। তখন আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল সাফাত ইসলাম আব্দুল্লাহ নামে। একইসঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোরআন ও হাদিস বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করি।’

ইন্টারনেট থেকে সাফফাত যেসব অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছে সেই তালিকায় উল্লেখযোগ্য—একে-৪৭, এম-১৬, একে-১২, এয়ার-৫০, মারকফ, গ্লোক-১৮, গ্লোক-১৫, এসআর-২৫, তুর্কিশ টি-৫০০০ স্নাইপার রাইফেল, ব্যারেট এম-৮২ এ১, সাব মেশিনগান, এমপিএস এমপি-৫, আরপিজি-৭, আরপিজি-২২, এসএসডি ড্রাগলাভ, হিকলার অ্যান্ড কোচ, এম-৮ কারবিনর, ডেজার্ট ঈগল, একে-৭৪, গ্লোক-৩৪ সি ইত্যাদি। 

ছেলেটির কথায়, ‘এসব অস্ত্রের নাম, ইফেক্টিভ রেঞ্জ, ওজন, কার্টিজ সাইজ সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে জেনেছি এবং ইউটিউব থেকে অস্ত্রগুলো চালাতে শিখেছি। এগুলোর ম্যানুফেকচারার সম্পর্কে জেনেছি। ২০১৮ সাল থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মার্শাল আর্ট শিখেছি। আদিম ও বর্তমান সময়ের যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে জেনেছি ও এসব রপ্ত করেছি।’

সিটিটিসি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদেও সাফফাত জানায়, ইন্টারনেটের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে মার্শাল আর্ট শেখে সে। অনলাইনে মুসলিম বীরযোদ্ধা উমর ইবনে খাত্তাব, কাকা বিন আমর, খালিদ বিন ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাশেম, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, সালাউদ্দিন আইয়ুবি, শাহিদ আব্দুর রহমান, আলী ইবনে সুফিয়ান, আল্প আরসালান, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিদের জীবনী ও তাদের জিহাদের বীরত্বগাথার বই পড়ে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত হয় এই কিশোর।
জবানবন্দিতে সাফফাত স্বীকার করেছে, ‘সশস্ত্র ও সাইবারে অর্থাৎ ইন্টারনেটভিত্তিক কাজের জন্য আলী খান, সুফিয়ান আলী, আব্দুর রহমান নামক আইডি বানাই। মুজাহিদ ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। অডিও-ভিডিওতে আমাদের কথা হয়। টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলি আলী ইবনে সুফিয়ান, সুলাইমান ১৪৭৫ নামে। গত ১৫ জুন এক ভাইয়ের (তদন্তের স্বার্থে নামটি প্রকাশ করা হলো না) সঙ্গে পরিচয় হয় ফেসবুকে। এরপর ফাইয়াজ হোসেন নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের সঙ্গে মেসেজে কথা বলি। ফাইয়াজ বলেছিল, একজন সামরিক উপদেষ্টা দরকার। আমি ওই পদে দায়িত্ব নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করি।’


জঙ্গিরা এখন ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

সিটিটিসি কর্মকর্তারাও সম্প্রতি একাধিক জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য পেয়েছেন।
ইউনিটের এই সদস্যরা বলছেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমেই অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে বোমা তৈরি পর্যন্ত শেখানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকা ও সিলেট থেকে কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে এই চিত্র উঠে আসে। এছাড়া ঘরে বসেই অস্ত্র চালনা থেকে শুরু করে বোমা তৈরির সব ম্যানুয়াল বাংলায় অনুবাদ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গিরা।
কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, জঙ্গিরা নিয়মিত অনলাইনে নিজেদের প্রচারণা চালায়। ইন্টারনেটে জঙ্গিবাদের মূল হোতারা একধরনের ফাঁদ পেতে বসে আছে। সাফফাতের মতো কোমলমতি কিশোর-তরুণদের তারা লক্ষ্য বানিয়ে উদ্বুদ্ধ করছে। একপর্যায়ে তাদের ঘর ছাড়তে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। জঙ্গিবাদের ফাঁদে পড়ে অনেকেই সাফফাতের মতো কথিত জিহাদের জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
সিটিটিসি'র উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইন্টারনেটের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সাফফাত। অস্ত্রের বিষয়ে তার কৌতূহল ছিল। সে নিয়মিত জিহাদি প্রচারণা পড়তো। এসব দেখে ও পড়ে ছেলেটি নিজে নিজে কথিত জিহাদে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। পরিবারের সদস্য বিশেষ করে বাবা-মায়ের সঙ্গে তার দূরত্ব ছিল। এই সুযোগে ইন্টারনেটে ওঁত পেতে থাকা জিহাদি নিয়োগকারীরা তাকে সংগঠনে ভর্তি করে ফেলে।’
পুলিশের এই কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘সাফফাত অল্প বয়সেই জিহাদি কন্টেন্ট পড়ে অনেক কিছু শিখেছিল। সে যদি আরও সময় বা সুযোগ পেতো তাহলে সংগঠনের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।’
বাসায় চুপচাপ থাকা মানেই ভালো থাকা নয়
বন্ধুবান্ধব নেই। খেলাধুলাতেও আগ্রহ কম। সাফফাত সারাদিন ঘরেই থাকতো। তার সবসময়ের সঙ্গী ছিল একটি স্মার্টফোন আর ল্যাপটপ।
সাফফাতের বাবা শহীদুল ইসলাম লিটন ঢাকার গাউসিয়া মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী। সারাদিন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ছেলে ঘরে থাকছে এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেন। ঘুণাক্ষরেও টের পাননি ছেলের আবদার মেটাতে কিনে দেওয়া ল্যাপটপ, স্মার্টফোন আর ঘরে এনে দেওয়া ইন্টারনেট সংযোগ তাকে নিয়ে গেছে জঙ্গিবাদের অন্ধকার পথে।
জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়ে কিশোর ছেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর পুরো পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় কাটছে তাদের দিন। যোগাযোগ করা হলে সাফফাতের বাবা শহীদুল ইসলাম অভিভাবক হিসেবে নিজের ব্যর্থতা এবং ছেলের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলতে চাননি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরামর্শ, কিশোর-তরুণরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনে কী করছে ও কী দেখছে, অভিভাবকদের তা খেয়াল রাখা উচিত। সাফফাতের বেলায় এমন খোঁজ-খবর নেয়নি পরিবারের কেউ। এ কারণে ছেলেটি জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়ে ঘর ছেড়েছিল।

  

ইয়াছির আরাফাত ওরফে শান্ত ও সাফফাত ইসলাম সাফফাত প্রসঙ্গে সহযোগী যা বলেছে
সাফফাতকে জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ কর্মকর্তা এবং এ সংক্রান্ত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বয়সে কিশোর হলেও জঙ্গিবাদ বিষয়ে তার জানাশোনা অনেক বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সিক্রেট অ্যাপসে সহযোগীদের সঙ্গে যখন কথা হতো তখন তারা কেউই আঁচ করতে পারতো না তার বয়স এত কম। সামনাসামনি দেখে অনেকেই চমকে যেতো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেলেটি নিয়মিত জঙ্গিবাদের প্রচারণা চালাতো। নব্য জেএমবির জন্য সদস্যও সংগ্রহ করেছে সে।
সাফফাতের সঙ্গে ইয়াছির আরাফাত ওরফে শান্ত নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করেছিল সিটিটিসি। পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে ২৩ আগস্ট সে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম সাদবীন ইয়াছির আহসান চৌধুরীর কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

ইয়াছির আরাফাতের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ‘২০২০ সালের মে মাসের দিকে আমার মুহাম্মদ বিন কাশিম আইডিতে আলী বিন সুফিয়ান নামক আইডি থেকে মেসেজ আসে। সে ভেবেছিল আমি কোনও জিহাদি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। সে যাচাই করে বুঝতে পারে আমি এমন কেউ নই এবং এ বিষয়ে সামান্য জানি। তখন আমাকে জানায়, সে দেশের বাইরে কোনও সংগঠনে যোগ দিতে ইচ্ছুক। এজন্য তার দুইজন লোক দরকার। সামান্য দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও পরে রাজি হই। আমরা প্রতিদিন মেসেঞ্জারে অডিও কলে কথা বলতে থাকি। আলী বিন সুফিয়ান আইডি থেকে আমাকে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও জিহাদ সম্পর্কে কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিস দেওয়া হতো। আত্মরক্ষা শেখার জন্য ভিডিও দিতো।’

সাফফাত সিরিয়া বা আফগানিস্তানের খোরাসানে গিয়ে আন্তর্জাতিক কোনও জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে কথিত জিহাদে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতে পারেনি। দেশে বসেই নব্য জেএমবি’র হয়ে একটি সেল সংগঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছিল।

জবানবন্দিতে ইয়াছির আরাফাত বলেছে, ‘মুহাম্মদ বিন কাশিম আইডিতে সমস্যা দেখা দিলে আমি আর্তুগাল গাজী নামে আরেকটি ফেক আইডি খুলি। আলী বিন সুফিয়ানের (সাফফাত ইসলাম) সঙ্গে আগের মতো কথা চালিয়ে যেতে থাকি। ১৫-২০ দিন কথা বলার পর আমরা বাবুবাজার সেতুর ওপর সিঁড়িতে দেখা করি। দেখার আগে বুঝতে পারিনি তার বয়স এত কম। সে আমাকে আব্দুল্লাহ নামে পরিচয় দেয়। পরে জানতে পারি, তার নাম সাফাফাত ইসলাম আব্দুল্লাহ। সে দেশের বাইরে জিহাদে যোগ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করে। সেদিন আমরা চলে আসি এবং আগের মতো আমাদের কথাবার্তা চলতে থাকে। সে আমাকে আরও কয়েকজন লোক সংগ্রহ করতে বলে। এ ব্যাপারে কীভাবে কারও সঙ্গে আলোচনা করবো সেটাও শিখিয়ে দেয়। আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললেও তারা আগ্রহ দেখায়নি। এরপর কয়েকজনকে আব্দুল্লাহর আইডির সঙ্গে সংযুক্ত করিয়ে দেই।’

ইন্টারনেটে প্রতিনিয়ত জঙ্গিরা তাদের প্রচারণা চালাচ্ছে ইন্টারনেটে ওঁত পেতে বসে আছে জঙ্গি নিয়োগকারীরা

কথিত জিহাদে যোগ দিতে একটু-আধটু আগ্রহ প্রকাশ বা মন্তব্য করা কিশোর-তরুণদের লক্ষ্য বানায় এসব ব্যক্তি।  

এজন্য জঙ্গি নিয়োগকারীরা বিভিন্ন রকমের জিহাদি উপকরণ প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দিচ্ছে অনলাইনে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ছড়িয়ে দিয়ে ওঁত পেতে বসে থাকা তারা। কোনও কিশোর-তরুণের মধ্যে এ নিয়ে একটু-আধটু আগ্রহ দেখা গেলে তাদের ধীরে ধীরে উদ্বুদ্ধ করা হয়। একপর্যায়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে অনেকে।

জঙ্গিবাদ দমনে বিশেষায়িত ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন প্রায় প্রত্যেকের হাতে হাতে স্মার্টফোন। একটু সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা ল্যাপটপ ব্যবহার করে। দ্রুতগতির ইন্টারনেট এখন সহজলভ্য। জঙ্গি রিক্রুটাররা প্রতিনিয়ত প্রচারণা চালিয়ে কিংবা কোরআন হাদিসের খণ্ডিত ব্যাখ্যা দিয়ে জিহাদে যোগ দেওয়ার ডাক দিয়ে যাচ্ছে। যারা কৌতূহলী হয়ে নিজে নিজে এসব কন্টেন্ট ঘাঁটাঘাঁটি করে থাকে তাদের অনেকেই একসময় উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যায়।

কিশোর-তরুণরা ঘরে বসে জঙ্গিবাদি উপকরণ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে কিনা সেদিকে খোঁজ-খবর রাখা উচিত অভিভাবকদের।

সাইবার ও কাউন্টার টেরোরিজম বিশেষজ্ঞরা এই পরামর্শ দিয়েছেন।

সিটিটিসি কর্মকর্তাদের মন্তব্য, ‘ইন্টারনেট এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে ইতিবাচক তথ্যের পাশাপাশি জঙ্গিবাদে উস্কানিমূলক উপকরণও আছে। এসব একটি বন্ধ করলে আরেকটি আপলোড হয়ে যায়। তাই জঙ্গিবাদী উপকরণ প্রকাশ পুরোপুরি বন্ধ করা খুব কঠিন। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কিশোর-তরুণদের কারও মনে কোনও প্রশ্ন থাকলে অভিজ্ঞ আলেমদের মাধ্যমে তা পরিষ্কার করে দিতে হবে তাদের। এক্ষেত্রে অভিভাবকরাই কেবল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাহলেই কোনও কিশোর-তরুণ ভুল পথে পা বাড়াবে না।’

কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে সবশেষে বলেন, ‘ইন্টারনেটে জঙ্গিবাদি উপকরণ ও কারা এসব প্রচার করছে সেদিকে নিয়মিত নজরদারি রাখছি আমরা। কিন্তু শুধু নজরদারি করে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততা ঠেকানো সম্ভব নয়। এজন্য সবার আগে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়া জরুরি।'

স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ নিয়ে কোনও কিশোর-তরুণী ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা একা পড়ে থাকে কিনা অভিভাবকদের তা গুরুত্বের সঙ্গে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন দীর্ঘদিন জঙ্গি দমনে কাজ করে আসা এই পুলিশ কর্মকর্তা।

/জেএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
উইটকফ বনাম আরাঘচি: ইরান-মার্কিন আলোচনায় মুখোমুখি দুই কূটনীতিক 
উইটকফ বনাম আরাঘচি: ইরান-মার্কিন আলোচনায় মুখোমুখি দুই কূটনীতিক 
সীতাকুণ্ডে যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
সীতাকুণ্ডে যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
হাজার বাউন্ডারিতে আইপিএলে কোহলির ইতিহাস
হাজার বাউন্ডারিতে আইপিএলে কোহলির ইতিহাস
ভারতে সাফের আগে বাংলাদেশের জোর প্রস্তুতি
ভারতে সাফের আগে বাংলাদেশের জোর প্রস্তুতি
সর্বাধিক পঠিত
ধর্ষণের ব্যথা সইতে না পেরে আল আমিনকে হত্যা, আদালতে স্বীকারোক্তি: পিবিআই
ধর্ষণের ব্যথা সইতে না পেরে আল আমিনকে হত্যা, আদালতে স্বীকারোক্তি: পিবিআই
ঢাকা লিগে আজ যে কাজ হয়েছে, সেটা দেশের ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করেছে: ইমরুল
ঢাকা লিগে আজ যে কাজ হয়েছে, সেটা দেশের ক্রিকেটকে কলঙ্কিত করেছে: ইমরুল
বগুড়ায় টিএমএসএসএ’র দখলে থাকা করতোয়া নদীর ১৭ একর জমি উদ্ধার
বগুড়ায় টিএমএসএসএ’র দখলে থাকা করতোয়া নদীর ১৭ একর জমি উদ্ধার
ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের পর রফতানি করা ৪ ট্রাক পণ্য ফেরত পাঠালো ভারত
ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের পর রফতানি করা ৪ ট্রাক পণ্য ফেরত পাঠালো ভারত
মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর ধর্মাচার: হেফাজত
মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুদের জন্মাষ্টমীর ধর্মাচার: হেফাজত