X
বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
১১ বৈশাখ ১৪৩২

বাধ্য হয়েই ‘যৌথ পরিবার’

উদিসা ইসলাম
২৮ মে ২০১৯, ০৭:৫৩আপডেট : ২৮ মে ২০১৯, ০৭:৫৪

যৌথ পরিবার দেশে আশির দশকে গড়ে ওঠা একক পরিবারে আর স্বস্তি মিলছে না। বিশেষ করে, কর্মজীবী বাবা-মায়েদের ব্যস্ততার কারণে একক পরিবারের শিশুরা এখন প্রায়ই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অপহরণ-নির্যাতন-যৌন হয়রানির মতো অপরাধগুলো ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তা, শিশুদের দেখা-শোনার প্রয়োজনেই বাবা-মায়ের পাশাপাশি দাদা-দাদি, নানা-নানিকেও একই ছাদের নিচে বা কাছাকাছি বাসায় থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, একক পরিবারে সুস্থভাবে একজন শিশুর বেড়ে ওঠা তখনই সম্ভব, যখন মা কর্মজীবী নন। কিন্তু কর্মজীবী মায়ের সন্তানকে নিরাপত্তা দেওয়ার কোনও উপায় না থাকায় পরিবারের সিনিয়র সদস্যদের সঙ্গে বসবাসের প্রবণতা বেড়েছে। নগর জীবনে স্বজনদের কাছাকাছি বাসা নিয়ে থাকার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। তবে, এই ব্যবস্থাকে ‘যৌথ পরিবার’ বলতে রাজি নন সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, এই ব্যবস্থা কেবল ‘একসঙ্গে থাকাই’, এরমধ্যে কোনও যৌথতা নেই। তাদের মতে, এই পদ্ধতি যৌথ-পরিবার নয়, বিষয়টি একেবারেই নিজেদের স্বার্থেই। সম্ভাব্য সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর জন্যই।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রীরা এখন নিজেদের সংসারের দেখাশোনার জন্য বৃদ্ধ বাবা-মা কিংবা নিকট আত্মীয়দের কাউকে কাউকে বাসায় এনে রাখছেন। এছাড়া ছোট সংসারে বিভিন্ন কারণে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির ঘটনাও ঘটে। এর রেশ ধরে সংসার ভেঙে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। এসব সমস্যার সমাধানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রী তাদের বাবা-মাকে নিজেদের বাসায় এনে রাখছেন। বিশেষ করে কর্মজীবীরা তাদের বাবা-মাকে নিজেদের বাসায় এনে রাখছেন মূলত সন্তানের দেখভাল করতেই। কারণ সন্তানের দেখভালের জন্য পরিবারের সদস্যদের মতো কেউ আর নিরাপদ হতে পারেন না।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় রাজশাহীর হালিম আকবরের সঙ্গে। তিনি একসময় সরকারি চাকরি করতেন। তার দুই সন্তান। এক ছেলে ও এক মেয়ের। সন্তানরা বিয়ের পর যার যার সংসারে ব্যস্ত। তিনি অবসরে যাওয়ার দুই বছরের মাথায় একটি দোতলা বাড়ি করেন রাজশাহীতে। ওই বাড়ি তৈরির পর তিন মাস পরে ছেলের ঘর আলো করে আসে নাতি। তার ছেলে চাকরি করেন ঢাকায়। নাতিকে দেখাশোনার জন্য অনুরোধ আসে হালিম দম্পতির কাছে। ছেলের অনুরোধে দুই বছর আগে তারা দুজনেই নাতির দেখাশোনা করতে চলে আসেন ঢাকায়। সেই থেকে তার রাজশাহীর বাড়িটি তালাবদ্ধ। কেবল বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে যান, কিন্তু কষ্টের টাকায় তৈরি বাড়িতে তাদের আর থাকা হয় না। ছেলের দাবি, নাতিকে দেখাশোনা করতে ঢাকাতেই থাকতে হবে তাদের।
হালিম আকবরের মতো আরেক বৃদ্ধ অভিভাবক রাবেয়া খাতুন। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, চাকরি শেষে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়াবেন। তার ভাষ্য, চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরও ‘চাকরি’তে যোগ দিতে হয়েছে। পরিচিতজনদের প্রায় বলেন, নতুন ‘চাকরি’ সময় পাই না আগের মতো।
‘কী চাকরি করছেন’—জানতে চাইলে রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘মেয়ের ঘরের নাতি এবার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তাকে আনা-নেওয়ার কাজ করতে হয়। মেয়ে-জামাই দুজনেই চাকরি করে। আমি যদি এই কাজ না করি, তাহলে আমার মেয়েটাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। আমি সেটা চাই না।’
প্রবীণ সদস্যদের সংসারে এনে একই ছাদের নিচে রাখার এই পদ্ধতিকে ‘কেবলই প্রয়োজনের তাগিদ’ হিসাবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নেহাল করীম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেবল সন্তানের দেখভালের জন্য নয়, দাম্পত্য সম্পর্ক টেকাতেও পরিবারে সিনিয়র সদস্যদের একসঙ্গে রাখা হচ্ছে। একসঙ্গে থাকার প্রবণতা বাড়ছে।’
নেহাল করীম আরও বলেন, ‘আমাদের তেমন গবেষণা না থাকলেও পর্যবেক্ষণ বলছে, বর্তমানে ঘর ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। কর্মজীবী নারীকে যেমন সমস্যার মধ্য দিয়ে যাপন করতে হচ্ছে, তেমনি স্রেফ গৃহিণীকেও আরেক ধরনের টানাপড়েনের ভেতর দিয়ে চলতে হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্যই মূলত কর্মজীবীরা এখন তাদের বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজেদের সঙ্গে এনে রাখছেন।এসবই নিজেদের প্রয়োজনেই। এর সঙ্গে বাবা-মায়ের শ্রদ্ধা-ভক্তি-মায়ার কোনও সম্পর্ক নেই।’
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য পরিবেশ সহনীয় করতে দেশে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক মেজবাহ কামাল। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এ কারণেই সমাজ এখন বৃহত্তর পরিবারের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নারী যখন কর্মজীবী হয়, তখনই পরিবারের যে দাযিত্ব সে পালন করতো, তা পালনে সহায়তার জন্য কিছু ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আমাদের এখানে সেটি সম্ভব হয়নি। পুঁজির বিকাশ হচ্ছে, একক পরিবার হচ্ছে, কিন্তু সেই একক পরিবার টেকসই করতে যে সহযোগিতা দরকার, রাষ্ট্র সেটা দিতে পারছে না। এটি অনুন্নত পুঁজিবাদের জন্য সম্ভব হচ্ছে না। এটা যেহেতু পারছে না আবার নারীকে যেহেতু বাড়ির বাইরে কাজ করতে হবে, ফলে সন্তান নিয়ে সে পড়েছে ঝামেলায়। পুরো পরিস্থিতি সামাল দিতে একক পরিবারগুলো যৌথ পরিবার না হলেও বৃহত্তর পরিবারের দিকে যাচ্ছে।’
অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, ‘আয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ চলে যায় আবাসনের পেছনে। সেটি কমিয়ে আনতে ও জীবনমান ঠিক রাখতেও একসঙ্গে থাকার প্রবণতা বাড়ছে।’
একক পরিবারের ভালো-মন্দ দুটোই আছে বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টটিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আমরা চাইলেও স্বাভাবিক বিবর্তনকে আটকে রাখতে পারবো না। সমাজ বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবারের কাঠামোর ভেতরও পরিবর্তন এসেছে। ফলে সমাজ একসময় একক পরিবারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু যখন দেখা যাচ্ছে সন্তান লালনের ক্ষেত্রে সহযোগী প্রয়োজন, তখনই সামনে যে বিকল্পগুলো আছে, সেগুলো কতটা কার্যকর, সে প্রশ্ন উঠছে।’
অধ্যাপক তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘যৌথ পরিবারে শিশু বেড়ে উঠলে তার সামাজিক দক্ষতার জায়গা তীক্ষ্ণ হয়। পাশাপাশি তার মধ্যে কমিউনিটি ফিলিং, দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার প্রবণতাগুলোও বাড়ে।’ তবে, জোর করে যৌথ পরিবারের দিকে না গিয়ে আত্মীয়দের কাছাকাছি বসবাসের চেষ্টা থাকলেও অনেক সুবিধা পাওয়া যায় বলেও তিনি মনে করেন।

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এ বছর হামজাদের সাফ হচ্ছে না!
এ বছর হামজাদের সাফ হচ্ছে না!
তারিক সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে ৪ মামলার প্রতিবেদন ৩ জুলাই
৮১২ কোটি টাকা আত্মসাৎতারিক সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে ৪ মামলার প্রতিবেদন ৩ জুলাই
ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ দিয়ে দেন: ফারুক
ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের একটা রোডম্যাপ দিয়ে দেন: ফারুক
ঘুষের অভিযোগে অভিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন
ঘুষের অভিযোগে অভিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন
সর্বাধিক পঠিত
জোর করে পদত্যাগ করানো প্রধান শিক্ষককে মারধর করে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হলো
জোর করে পদত্যাগ করানো প্রধান শিক্ষককে মারধর করে বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হলো
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে মানববন্ধন
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে মানববন্ধন
কাশ্মীর ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা
কাশ্মীর ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা
কালচে বগলের সমস্যা যেভাবে দূর করবেন
কালচে বগলের সমস্যা যেভাবে দূর করবেন
প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে লাভ ১২ টাকা?
প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে লাভ ১২ টাকা?