কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া অভিযানের আগে জঙ্গিদের তোলা নিজেদের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। তার মানে কি জঙ্গিরা সত্যিই কথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএসের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছে? এর আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি ঘটনার পরও আইএসের আমাক এজেন্সিতে সেখানকার পাঁচ জঙ্গির ছবি প্রকাশিত হয়। যদিও পুলিশ কর্মকর্তারাও দাবি করেছেন, গুলশানের জঙ্গিদের সঙ্গে কল্যাণপুরের আস্তানায় হতাহত জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। বৃহস্পতিবার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামও জানান, কল্যাণপুরে নিহত রায়হান কবির ওরফে তারেক গুলশানে নিহত জঙ্গিদের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কথিত আইএসের পোশাক পরে জঙ্গিদের ছবি তোলার বিষয়টি কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখন তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই, দেশীয় জঙ্গিদের শক্ত আন্তর্জাতিক কানেকশন রয়েছে। এসব এখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। আমাদের এখন দ্রুত কৌশল প্রয়োগ করতে হবে তাদের কিভাবে নির্মূল করা যায়।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইএস কিন্তু আমাদের এখানে তাদের প্রভিন্স ঘোষণা করেনি। ফলে তাদের এখানে আসার কোনও কারণ নেই। বরং তারা এখন বলছে তোমরা যে যেখানে আছ, যদি তোমরা আমাদের যোদ্ধা হতে চাও, তাহলে নিজের এলাকাতেই মাঠে নেমে যাও। এখানে তাই শুরু হয়েছে।
ঢাকার কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারাও বলছেন, কল্যাণপুরের জঙ্গিরাও জেএমবির সদস্য হলেও তারা আইএসের আদর্শের অনুসারী। একারণে তারা আইএসের পতাকা পেছনে রেখে ছবিগুলো তুলেছিল। তারা নতুন কোনও বড় ধরনের নাশকতার আগে কোনও মাধ্যমে তা আইএসের কাছে পাঠাতো বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা গুলশানের ঘটনার মতো আইএসের কথিত আমাক এজেন্সির মাধ্যমে প্রকাশিত হতো।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিগোষ্ঠী জেএমবির একটি ভগ্নাংশ আইএসকে অনুসরণ করে তাদের কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরীসহ কয়েকজন এই গোষ্ঠীটিকে আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেএমবির এই ভগ্নাংশটি বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তারা মাদ্রাসা থেকে শুরু করে ইংলিশ মিডিয়াম ও সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত অসংখ্য তরুণকে নিজেদের দলে ভেড়াতে সক্ষম হয়েছে। তাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। তবে বর্তমানে যেহেতু আইএস নিজের দেশেই কাজ করতে বলছে সে কারণে তারা দেশের ভেতরেই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলছেন, কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত আলামতের মধ্যে কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে কিছু ছবি উদ্ধার করেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে অস্ত্র হাতে এবং আইএসের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের ধারণা মঙ্গলবারের অভিযানের আগে যেকোনও দিন তারা এই ছবি তুলে থাকতে পারে। জঙ্গিরা ওই আস্তানায় জড়ো হয়েছিল বড় কোনও হামলার পরিকল্পনা নিয়ে। গুলশানের ঘটনার মতো কোনও হামলা বা নাশকতার পর আইএসের আমাক এজেন্সির মাধ্যমে এসব ছবি প্রকাশের পরিকল্পনা ছিল তাদের।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, অভিযানের পর তারা ওই বাসা থেকে কিছু ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ভাঙা অবস্থায় উদ্ধার করেন। তাদের ধারণা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন এসব ডিভাইস থেকে কোনও গোপন তথ্য উদ্ধার করতে না পারে, সে জন্যই এসব ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তবে ছবিগুলো যেহেতু জঙ্গিদের অস্তিত্ব এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে, এ কারণে তা নষ্ট করা হয়নি। কিংবা এমনও হতে পারে যে, এসব ডিভাইস তারা নষ্ট করার সুযোগ পায়নি। পুলিশ ওই বাসা থেকে অন্তত দুটি পেন ড্রাইভ উদ্ধার করেছে বলে মামলার জব্দ তালিকায় উল্লেখ রয়েছে। একটি সূত্র বলছে, পুলিশ আসলে পেন ড্রাইভ দুটি থেকেই এই ছবিগুলো উদ্ধার করেছে।
সিটির একজন কর্মকর্তা জানান, কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে তারা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন, যাতে জেএমবির এই ভগ্নাংশের বিস্তারিত নেটওয়ার্ক, মাস্টারমাইন্ড, অর্থদাতা, অস্ত্রের যোগানদাতা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপনের হোতাদের শনাক্ত করতে সহজ হবে। ইতোমধ্যে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই শুরু করছেন তারা। একই সঙ্গে নেপথ্যে থাকা এই গ্রুপটিকে শনাক্তেরও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আইএসের পোশাক পরিহিত ছবির পাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা অনেক কিছুই পেয়েছি। এর মধ্যে ছবিও রয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের তাজ মঞ্জিলে অভিযান চালিয়ে একটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। জঙ্গিরা পুলিশকে প্রতিরোধ করলে রাত শেষে ভোর ৫ টা ৫১ মিনিটে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াতের নেতৃত্বে এক ঘণ্টার অভিযান চালানো হয়। এতে আস্তানায় ৯ জঙ্গি নিহত হয়। এছাড়া পালিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান নামে একজনকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করে পুলিশ। অন্য একজন পালিয়ে যায়।
নিহত ৯ জঙ্গির মধ্যে ৮ জনের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তারা হলো- দিনাজপুরের আব্দুল্লাহ ওরফে মোতালেব, টাঙ্গাইলের আবু হাকিম ওরফে নাইম, ঢাকা ধানমণ্ডির তাজ-উল-রাশিক, গুলশানের আকিফুজ্জামান, সাতক্ষীরা মতিয়ার রহমান, নোয়াখালীর জোবায়ের হোসেন, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সাজাদ রউফ ওরফে অর্ক ও রংপুরের রায়হান কবির ওরফে তারেক। নিহত অন্য একজনের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
নিহতদের মধ্যে অন্তত তিনজন ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথের ছাত্র। বাকিদের মধ্যে তিনজন মাদ্রাসার ছাত্র, একজন নোয়াখালীর একটি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স করেছেন আর একজন চতুর্থ শ্রেণি পাস। অন্য একজনের পরিচয় এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
আরও পড়তে পারেন: কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা: নিহত হওয়ার আগের ছবি
/এমএনএইচ/