প্রথমে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের পর সম্প্রতি আরও চারটি বিষয়ে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করে দিয়েছে সরকার। এরমধ্যে একটি হলো শ্রমিক অধিকার সংস্কার বিষয়ক কমিশন। এই কমিশনের প্রধান হলেন সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক। শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রশ্নে সুলতান উদ্দিন পরিচিত নাম। আশির দশকজুড়ে ব্যাংকে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। তিনি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও এবং আন্তর্জাতিক ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন-আইটিইউসিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। মাঠের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ঠিক কোন জায়গাগুলো সংস্কার করা জরুরি, অধিকার বলতে শ্রমিক-মালিকের জন্য তিনি কোন জায়গাগুলো নির্ধারণ করে দিতে চান এবং এটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনার বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
বাংলা ট্রিবিউন: শ্রমিক অধিকার সংস্কার কমিশন গঠিত হলো, এটা এক ধরনের আশার আলো সঞ্চার করছে। কারণ শ্রমিকদের জন্য আসলে কেউ কিছু করতে চায় না, আপনার কী মনে হয়?
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: এটা ঠিক যে এখনও পর্যন্ত শ্রমিক ইস্যুতে কমিটি হয়েছে, শ্রম আইন নিয়ে একবার একটা কমিশন হয়েছিল, কিন্তু শ্রম অধিকার বিষয়টি দেখার জন্য প্রস্তাবনা তৈরি করতে এর আগে কোনও কমিশন হয়নি। এক্ষেত্রে অবশ্যই এটির আলাদা বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য আছে। আর মানুষ আশার আলো দেখছে। কারণ, বাংলাদেশে সবচেয়ে বঞ্চিত শ্রমিকরা। তারা সবচেয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। সুতরাং, তাদের জন্য যখন একটি কমিশন হয়, বঞ্চিত মানুষকে সেটা আশা দেয়। তবে, এটা আবার চাপও সৃষ্টি করছে কমিশনের ওপরে। আমরা এই স্বল্প সময়ের মধ্যে কতটুকু করে যেতে পারবো। আপনি যেরকম বলেছেন, যেহেতু আমরা মাঠপর্যায়ে থেকে কাজ শুরু করে এখানে এসেছি এবং প্রচুর মানুষ তার আশা, মতামত ব্যক্ত করছে, আমরা মনে করি— অসম্ভব না, আমরা করতে পারবো।
বাংলা ট্রিবিউন: শ্রম অধিকারের সংস্কার কথাটাতো অনেক বিস্তৃত…
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: হ্যাঁ।
বাংলা ট্রিবিউন: সেখান থেকে ছোট করে নিয়ে এসে কোন কোন অধিকারের জায়গাগুলো সংস্কার হওয়া দরকার মনে করছেন?
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার খুবই সংকুচিত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। যেটা অনেক সময় আমাদের সমাজ বিশেষ করে নীতিনির্ধারকরা খেয়াল করি না। অধিকার বলতে সেটি আইনানুগভাবে নিশ্চিত হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী ৮৫ ভাগ শ্রমিকের কোনও আইনানুগ সুরক্ষা নেই। তার মানে বাংলাদেশের ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ শ্রমজীবী মানুষ সব ধরনের অধিকারের স্বীকৃতি এবং সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাহলে বুঝতে পারেন, কত ব্যাপকভাবে কাজটা করা দরকার। আমরা যাদেরকে নিয়ে কথা বলি, কিছু হলেই আমরা বলি— শ্রম অসন্তোষ, শিল্প অসন্তোষ, এটা নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় সীমাদ্ধ এবং একটি- দুটি সেক্টরে সীমাবদ্ধ। এটা ভাঙতে চাই, এখানে সংস্কার দরকার। অধিকার বলতে সব শ্রমজীবী মানুষের সুরক্ষা। এই অধিকারের নিশ্চয়তা যখন আপনি দেবেন, তখন অনেকগুলো বিষয় আসবে। সুরক্ষা মানে কিসের সুরক্ষা। প্রথমত, জীবন এবং জীবিকার সুরক্ষা। এই যে বাংলাদেশের ধারাবাহিকভাবে দুর্ঘটনা ঘটে, প্রতিকারহীনভাবে দুর্ঘটনা। এর না আছে কোনও বিচার, না আছে আইনের পরিবর্তন করে আরও কার্যকর করা যায় তার ব্যবস্থা করা, না আছে উপপুক্ত ক্ষতিপূরণ। একটা-দুটো ঘটনা বাদ দিলে, তাজরীন বা রানা প্লাজা বাদ দিলে, কেউই আসলে কোনও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায়নি। সুতরাং, নিরাপত্তার ব্যাপার আছে, বাংলাদেশে কোনও শ্রমিকের জন্য জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তার যে কর্মসূচি, সেটি নেই। একজন লোক ৬৫ বছর রিকশা চালাবার পর সে কী করবে? সে কোথায় যাবে? কেউ জানে না। সে যে রোদ- বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমাজ সচল রাখলো, তার দায়িত্ব কে নেবে। রিকশাচালক বাদ দেন, যে প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করে, যদি প্রাইভেট সেক্টর তার জন্য কোনও ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তার আদায় করার ব্যবস্থা নেই। শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এবং বৃহৎ ব্যক্তি খাতের জন্য কিছু গ্র্যাচুয়িটির ব্যবস্থা আছে আইনে। অতএব, সংস্কার যদি বলেন শূন্য থেকে শুরু করতে হবে এখানে। যেহেতু সময় কম, আমরা যাবো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মৌলিক সংস্কারগুলো করার দিকে।
বাংলা ট্রিবিউন: সেটা কী রকম?
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: যেমন- শ্রম আইনের আওতায় সবাইকে নিয়ে আসা, সবার জন্য একটা পরিচয় নিশ্চিত করা, যাতে সবাই ডাটাবেজে থাকে। আপনারা জানেন হয়তো, করোনার সময় সরকার যে ভাতা দিতে চেয়েছে, সেটার অর্ধেকও দিতে পারেনি। সরকারি প্রতিবেদনেই পরে বের হয়েছিল যে, তারা মাসে আড়াই হাজার টাকা করে শ্রমিকদের দিতে চেয়েছিল। ৫৭ শতাংশ লোককে সেটা দিতে পারেনি। কারণ, বাংলাদেশের কোনও শ্রমজীবী মানুষের তথ্য ভাণ্ডার নেই। তাহলে একটা তথ্য ভাণ্ডার থাকা দরকার। এই যে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আমরা তাদের যুক্ত করতে চাই, আইনের সুরক্ষা, জাতীয় ন্যূনতম মজুরির মানদণ্ড, যাতে প্রত্যেক সেক্টর ওটাকে ভিত্তি করে এগোতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের এখানে গৃহশ্রমিকদের বেতন নির্ধারণ হয় পাশের বাসার ভাবি কত দেবে, তার ওপরে। নির্মাণ শ্রমিকদের বেতন নির্ধারিত হয় কন্ট্রাকটর কত দিতে পারে।
বাংলা ট্রিুবিউন: কিন্তু একইসঙ্গে আরেকটা জিনিস আছে বলে মনে হয় কিনা— শ্রমিক বলতে আমরা কেবল গার্মেন্টস শ্রমিক বুঝি।
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: ওইটা ভাঙতে চাই। মজুরির বিনিময়ে যে শ্রম দিচ্ছে সেই শ্রমিক। এবং সে কতগুলো মৌলিক সুরক্ষার অধিকার রাখে। তারমধ্যে প্রথম হচ্ছে, সে যেখানে কাজ করবে সেখানে সে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সে তার জীবনের নিরাপত্তা ও নিরাপদ কাজের অধিকার পাবে। সে যে মজুরি পাবে তা দিয়ে যেন পরিবার নিয়ে চলতে পারে। কাজের শেষে সে যেন সামাজিক নিরাপত্তার অংশ থাকে, সন্তানের শিক্ষা নিয়ে, নিজের শেষ জীবনে যেন চিন্তা না করতে হয়। সর্বোপরি, অধিকার যেন সে নিজে দাবি করতে পারে।
বাংলা ট্রিবিউ: ক্ষতিপূরণ নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। কিন্তু একটু আগে বললেন, রানাপ্লাজা ও তাজরীনের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকেরা যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, আসলে কি যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ পেয়েছে?
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: যৌক্তিক না, কিছূটা পেয়েছে। এটাকে যৌক্তিক বলা যাবে না। ক্ষতিপূরণ কোনোদিন যৌক্তিক হয় না। রানা প্লাজার ক্ষেত্রে একটা মানদণ্ড নির্ধারণ করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী পরে আমরা আইনকে পরিবর্তন করতে পারিনি। আইনে তো এখনও আছে দুই লাখ ও আড়াই লাখ টাকা। সে অনুযায়ী দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির পরিমাণ বাড়াতে পারেনি। হাশেমপুর ফ্যাক্টরিতে ১০ শিশু মারা গেছে পুড়ে। শ্রমিকদের লাশ ডিএনএ পরীক্ষা করে শনাক্ত করতে হয়েছে। তার কী শাস্তি হয়েছে। তারা ক্ষতিপূরণ কি পেয়েছে। ওই দুই লাখ টাকাই এবং এই দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নাম করে তাকে (অভিযুক্ত মালিক) জেল থেকে মুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, সে বেরোতে না পারলে কিছু করতে পারবে না। আমি বলছি না যে, সব মালিকই দায়ী হবে, তা না। যখনই আমরা শ্রমিক অধিকারের কথা বলবো, তখনই আমরা একটা শিল্প সম্পর্কের কথা বলবো। উন্নত শিল্প সম্পর্ক। আর উন্নত শিল্প সম্পর্ক মানে মালিকও তার ন্যায্য অবস্থানটা পাবে। একজন উদ্যোক্তা, তিনি একটা শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারও যেমন নিরাপত্তা থাকবে, শ্রমিকেরও অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে। ন্যায্য হিস্যার যে বিমিনয়টা, যার যার ন্যায্য হিস্যাটা সে পাবে। এটা করলেই কিন্তু একটা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। এটা করলেই শিল্পটার উন্নয়ন হবে। শ্রমিক যখন বুঝবে— এই শিল্পে কাজ করে আমি একটা মর্যাদাকর জীবনযাপন করতে পারছি এবং আমি পরিচয় দিতে পারছি, আমার ২০ বছর পরের একটা নিশ্চয়তা জমা হচ্ছে, এর লাভ থেকে আমি একটা অংশ পাচ্ছি। এর উন্নয়ন হলে আমারও একটা উন্নয়ন হচ্ছে। তখন সে নিজেই ওই শিল্প রক্ষা করবে।
বাংলা ট্রিবিউন: আমাদের এখানে মালিক-শ্রমিক যে সম্পর্ক, সবসময় আমরা দেখি, মুখোমুখি অবস্থান করেন তারা। আর আপনাকে আমরা সবসময় পেয়েছি মাঠে শ্রমিকের হয়ে কথা বলতে। এখানে কি কোনও কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট দেখতে পান? মালিক কি আপনাকে মানবে?
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: এখানে মালিকদের আমরা যদি যুক্তি দিয়ে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করি— তাহলে না মানার কিছু নেই। আর যারা মানবে না, আপনি যতই যুক্তি দেন তারা মানবে না। মালিকদের যে নেতারা আছেন, তাদের সঙ্গে সবসময়ই যখন আমরা টেবিলে বসি, তারা যুক্তগুলো মেনে নেন। যারা মানেন না তারা হচ্ছে— একদম বটম লাইনে যারা মনে করেন যে, কোনোভাবে একটা ব্যবসা চালাতে পারলেই হলো। মুদি দোকান টাইপের যে সংস্কৃতি, এটা দিয়েতো শিল্প হবে না। এটা একটা দিক। জাতীয়ভাবে আমাদের একটা মানসিকতা হলো— যেহেতু অনেক মানুষের দেশ, সেহেতু এখানে কোনোভাবে একটা কাজের নিশ্চয়তা দরকার। এনি জব ইজ বেটার দ্যান নো জব। যার জন্য সরকার নীতিমালা বাস্তবায়নে অত কড়াকড়ি করে না। এই কারণে অনেকে সুযোগ পেয়ে যান যে, ঠিক আছে কোনোভাবে একটা চাকরি দিলেই তো আমি একটা ভালো কাজ করলাম। আরেকটা মানসিকতা ও দর্শন হলো আমাদের মজুরি কম বলে টিকে থাকতে পারি। এই দুটোর জায়গায় মানসিকতার জায়গায় সংস্কার দরকার। মূলত, এনি জব বেটার দ্যান নো জবে মানুষের দক্ষতা হারায়। সমাজে বৈষম্য বাড়ে। বাংলাদেশ বৈষম্যের দিকে থেকে নীচের দিক দিয়ে ১০ নম্বরে আছে, এটা বিআইডিএস-এর তথ্য। আমাদের না। সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী। আমরা যদি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই, আমরা যদি একটা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই— আমাদের প্রথমেই একটা মজুরি কাঠামো তৈরি করতে হবে। সেই মজুরি কাঠামো হতে হবে ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে। আমরা বলছি না যে, মালিকের লাভ সব নিয়ে যাবে শ্রমিক। বা আমরা এও বলছি না যে, কারখানা বন্ধ থাকবে। বরং আমরা যা বলবো, কারখানা কোনোদিন বন্ধ হবে না। কারখানার ভেতরে যদি শ্রমিক ও মালিকের আলোচনার পথ খোলা থাকে, শ্রমিক যদি তার অসন্তোষটা প্রকাশ করতে পারে, সেটা যদি মালিক শোনে ও গুরুত্ব দেয়– তাহলে অনেক অসন্তোষ হবে না। শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে শ্রমিক দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু না-ই শোনে যদি, শ্রমিককে অসন্তোষ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে হয় যদি, তাহলে রাস্তা ব্লক হবে। সুতরাং, আমাদেরটা শুধু বিছ্চিন্নভাবে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়। শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি শিল্পউন্নত দেশ তৈরি করা এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র তৈরি করা। এভাবেই আমরা দেখছি বিষয়গুলো।
বাংলা ট্রিবিউন: সেই ক্ষেত্রে আপনার কমিশনের সদস্য কারা হতে পারেন, সে বিষয়ে কিছু ভেবেছেন কিনা?
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: আমরা বলছি, টিম টা হতে হবে সব জায়গার প্রতিনিধিত্বশীল। যেমন- একজন ভালো আইনজীবী, একজন অর্থনীতিবিদ থাকবেন, একজন সমাজবিজ্ঞানী থাকবেন। শুধুমাত্র একটা ট্রেড ইউনিয়নের টিম হবে না। আমাদের মতো শ্রমিকদের নিয়ে যারা কাজ করছি তারাই থাকবে, সেটা না। যাতে সমাজের সবার মতামতের প্রতিফলন হয় এবং সবাই যতে এটাকে গ্রহণ করে। আরেকটা জরুরি যেটা আমি চিন্তা করছি – এখানে একটু মাঠ পর্যায়ে শ্রমিকদের মতামতটার প্রতিফলন যেনো থাকে। আমরা উপরি কাঠামোতে যারা কাজ করি, তাদের একটা মাইন্ডসেট হয়ে আছে। আমরা জানি আমাদের গবেষকরা আছেন, সাংবাদিকরা আছেন, আপনাদের কথাও আমরা শুনতে চাই। কিন্তু একদম শ্রমিকদের কথা, যেমন- নির্মাণ শ্রমিকদের কথা শুনতে চাচ্ছি, আশুলিয়ার চায়ের দোকানদারের কথাও শুনতে চাচ্ছি। শিল্পাঞ্চলগুলোতে এখন বড় ধরনের সংস্কারের ব্যাপার আছে। এখানে না আছে বাচ্চাদের স্কুল, না আছে চ্যারিটেবল হাসপাতাল, না আছে বসার কোনও জায়গা, সেখানেও সংস্কার দরকার। অর্থাৎ শ্রমিক অধিকার সংস্কার মানে শুধু গৎবাঁধা কিছু অধিকারের সংস্কার না। এর সঙ্গে অনেককিছু সম্পর্কিত। যে আইন বাস্তবায়নকারী সংস্থা আছে, তাদের সংস্কারের ব্যাপার আছে। চেষ্টা করবো সবাইকে নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে। এটা তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত একটা কমিশন। এটার তো প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। এটা একটা স্বাধীন কমিশন। সুতরাং, আমরা প্রস্তাবনা পেশ করবো। সেই প্রস্তাবনার একটা দলিল থাকে যেন। শ্রমিকের জন্য গাইডলাইন এবং যারা শ্রমিকদের মুক্তির জন্য কাজ করে, তাদের জন্য একটা দিক নির্দেশনা।
বাংলা ট্রিবিউন: এই যে এত কষ্ট করে, এত গুছিয়ে একটা সংস্কার পদ্ধতি আপনি উপস্থাপন করবেন। পরবর্তী সরকার সেটা বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা রাখবে বলে মনে হয়?
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: এটাতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমরা চেষ্টা করবো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যাদের শ্রম সম্পাদক আছে, তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে, যাতে প্রতিবেদনটা তারাও গ্রহণ করে। আমি মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের একটা দায়িত্ব হবে— এই রিপোর্টগুলো যখন হবে, সেটাকে ধরে রাজনৈতিক একটা অঙ্গীকার তৈরি করা এবং এটা যেন বাস্তবায়িত হয়— সেজন্য একটা ব্যবস্থা নেওয়া। নাহলে এতকিছু হলো কেন, কেবল আমরা না তো। কত মানুষ স্যাক্রিফাইস করলো। কত জীবন গেলো। আবার এখনও তো অনেক মানুষ কাজ করছে। সব মিলিয়ে এটা করতে হবে। না হলে পরিশ্রমটা হয়তো অতটা ফলপ্রসূ হবে না। শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আমরা আশাবাদী, যদি প্রতিবেদন তৈরি হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তী সময়ে ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকরা নির্বাচনের সময় প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে যে, এই প্রতিবেদন নিয়ে আপনাদের অবস্থান কী। সুতরাং, একটা দলিল হয়ে গেলে কোনও না কোনোভাবে মানুষ এগিয়ে নেবে এটাকে।
বাংলা ট্রিবিউন: শ্রমিকরা দলিলটা নিজের ভাবুক, তারা যেন ভাবতে পারে— এই দলিলটা আমার অধিকারের কথা বলে। সেজন্য আপনাদের কোনও পদ্ধতি নিয়ে চিন্তাভাবনা আছে?
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: ওই যে বললাম, মাঠ পর্যায় পর্যন্ত আমরা যাবো। ইচ্ছা আছে, এখনতো কেবল শুরু হলো, সহজভাবে অনলাইন পোর্টাল করা হবে, যাতে শ্রমিকরা বিষয়গুলো জানবে ও তাদের প্রস্তাবনা পাঠাতে পারবে। আর চূড়ান্তভাবে কী বলছি, আমরা সেটাও যেন সে বিস্তারিত জানতে পারে। শ্রমিক এটাকে ধারণ করলে, তবেই এটা এগোবে, নাহলে এগোবে না। যতই অঙ্গীকার করুক, যদি মাঠ পর্যায় থেকে চাপ না থাকলে এটা এগোবে না।
বাংলা ট্রিবিউন: আমাদের নানা মতের ও নানা পথের শ্রমিক সংগঠন আছে। তাদের এখানে অন্তর্ভুক্ত করবেন কীভাবে?
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: এখানে একটা সুবিধা হলো— আমাদেরতো মোর্চা আছে। যেমন- শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ, জাতীয়ভাবে মোর্চা তারা। ছোট করে আলোচনা সবার সঙ্গেই করতে চাই। কিন্তু শ্রমের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের বক্তব্যে খুব পার্থক্য থাকে না, তাদের প্লাটফর্মগুলো ভিন্ন, বক্তব্য কাছাকাছি। সমস্যা হলো বক্তব্যগুলো সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে। ওই যে বলছিলেন শুরুতে যে, আমরা শ্রমিক বলতে গার্মেন্টস বুঝি, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের অন্যদের সঙ্গেও বসতে হবে। জেলে পল্লী, শুটকি মাছ, চা বাগান— এরকম কিছু কিছু জায়গায় আমাদের সশরীরে যেতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনাদের জন্য শুভ কামনা থাকলো, শ্রমিকদের উদ্দেশে যদি কিছু বলার থাকে।
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ: এটা একটা অধিকারের সংগ্রামের অংশ। এখানে যেনো আমরা সবাই অংশগ্রহণ করি। সবাই যেন মতামতটা জানায়, আমরা ব্যবস্থা নেবো যাতে সবাই মতামত দিতে পারে। স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এলে আরও ভালো। বিশেষ করে যারা শ্রমিকদের নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের সহযোগিতা খুব দরকার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য। এটা আমরা চেষ্টা করবো— এখানে যাতে তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনাকে ধন্যবাদ।