গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল থানাসহ রাজধানীর ট্রাফিক পয়েন্টগুলো। পরে শিক্ষার্থী ও জনসাধারণের উদ্যোগে সেগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে বেশ কিছুদিন। পুলিশ কাজে ফিরলেও রাজধানীতে যানজট কমেনি। সিগন্যাল না মানা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের সঙ্গে এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য। অন্যান্য খাতের মতো রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাতেও ‘সংস্কার উদ্যোগের’ কথাও বলা হচ্ছে। তবে দায়িত্বরতরা বলছেন, যানজটের প্রধান কারণ আইন না মানা। আইন মানার সংস্কৃতি যদি গড়ে না ওঠে, তাহলে পুলিশের একার পক্ষে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সম্ভব নয়।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির সদর দফতরে রাজধানীর ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নানা সমস্যা, সম্ভাব্য সমাধান এবং যানজট নিরসনের ট্রাফিক বিভাগের পরিকল্পনা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসানের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
এসময় তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষই আইন মানতে চান না। অর্থাৎ শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ আইন মানেন না। রাস্তার বেশিরভাগ থাকে অবৈধ পার্কিংয়ের দখলে। তাছাড়া রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্য এখন চরমে। মানুষ আইন অমান্য করাটাকেই কৃতিত্ব মনে করেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইন অমান্যের প্রবণতা বেড়েছে। ট্রাফিকের সাধারণ সদস্যদের অনেকেই পাত্তা দিতে চান না।’
সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ নিচে বাংলা ট্রিবিউনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
বাংলা ট্রিবিউন: ২০১৮ সালে এবং ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর কিছুদিন শিক্ষার্থীরা সড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছিল। তখন সিংহভাগ মানুষ আইন মেনে সড়কে চলাচল করেছেন। তাহলে এখন কেন আইন ভঙ্গের হিড়িক দেখা যাচ্ছে?
খোন্দকার নজমুল হাসান: শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তায় মেনে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছিল, তখন যানবাহনের সংখ্যা কম ছিল। প্রতিটি ইন্টারসেকশনে (সিগন্যাল) অনেক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল। এছাড়াও তখন শিক্ষার্থীদের হাতে লাঠি-সোটা থাকায় আইন ভঙ্গ করতে অনেকেই ভীতি ছিল। অনেকের মধ্যে সম্মানহানির ভয় ছিল। আমরা দেখেছি— যারা আন্দোলন করেছেন, যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজ করেছেন। তারাও এখন আইন মানছেন না। আইন মানার সংস্কৃতি যদি গড়ে না ওঠে, তাহলে পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব না। আমাদের আইন মানার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং জনসাধারণের জনসচেতনতায় আবারও শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা চান কিনা?
খোন্দকার নজমুল হাসান: আমরা দেখেছি সরকার পতনের পর যখন ট্রাফিক পুলিশ পুরোপুরি কাজ শুরু করেছে। তখন মিরপুরসহ কয়েকটি এলাকায় ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তায় কিছু শিক্ষার্থী নেমেছিল। সেখানে আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীদের ব্যানারে কিছু স্বার্থন্বেষী মানুষ ঢুকে অপকর্ম করেছে। দিনশেষে দেখতে হবে আমরা যতটুকুই কাজ করছি, সেটা যেন কোয়ালিটি পূর্ণ কাজ হয়। সাপোজ, আমি যদি পাঁচটা কাজ ভালো করি, আর একটা কাজ খারাপ করি। তাহলে সেই খারাপ কাজটাই বেশি ছড়াবে। পুলিশ ভালো কাজ করবে, এটাই তার দায়িত্ব। আর যদি একটা খারাপ কাজ করে। তাহলে সেটা নিউজ হবে। এখন পুলিশের সঙ্গে থেকে কোনও শিক্ষার্থী যদি খারাপ কাজ করে, তাহলে তার ওপরে আমাদের কোনও কন্ট্রোল থাকবে না। সেটার লায়াবিলিটি তো আমরা নিতে পারবো না। আমরা চাই যে কেউ আমাদের সহযোগিতা করুক। তবে ট্রাফিক সিস্টেম পুলিশ যতটা বুঝবে। সেটা শিক্ষার্থী বা অন্যকেউ ততটা বুঝবে না। তারা কাজ করবে আবেগ দিয়ে আর পুলিশ কাজ করবে তার আইন দিয়ে। আবেগ আর আইন এক না।
বাংলা ট্রিবিউন: আইন প্রয়োগে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা কি কোনও বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন?
খোন্দকার নজমুল হাসান: বর্তমানে সড়কে চলাচলকারী অনেকেই আছেন, যারা আইন মানতে চান না। যদি ৮০ শতাংশ মানুষ আইন না মানে তাহলে বাকি ২০ শতাংশও মানবে না। আবার যদি ৮০ ভাগ মানুষ আইন মানেন, তাহলে বাকি ২০ ভাগ অটোই আইন মানবে। বর্তমানে অধিকাংশ মানুষই আইন মানতে চান না। উল্টোপথে চলাচল করে, ট্রাফিক সিগন্যাল মানছেন না, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে চান। আবার অনেকেই পুলিশের সঙ্গে খারাপ আচরণও করেন। কিছুদিন আগে একটি রিকশা উল্টোপথে আসায় তাকে পুলিশ সদস্যরা আটকানো চেষ্টা করলে চালক কোনও কথা বলছে না। অথচ যাত্রী পুলিশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন। এমন ঘটনা এখন প্রায়শই ঘটছে। এরপরও আমাদের পুলিশ সদস্যরা ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। কেন জানি আমরা বেশি স্বাধীন হয়ে গেছি। স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছে তাই করা না। স্বাধীনতা মানে অন্যের অধিকার খর্ব করা না। আসলে স্বাধীনতা মানে শালীনতা, অন্যের অধিকার খর্ব না করা এবং স্বাধীনতা মানে আমার নিজের অধিকারের সঙ্গে অন্যের অধিকার সংরক্ষণ করা। তবে আমরা আশা করছি চালক, যাত্রীসহ জনসাধারণ সড়ক পরিবহন আইন সম্পর্কে জানলে ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এসব সমস্যা কেটে যাবে।
বাংলা ট্রিবিউন: ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে কতগুলো গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে?
খোন্দকার নজমুল হাসান: ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে সেপ্টেম্বর থেকে ট্রাফিক আইনে মামলা ও জরিমানা করা শুরু হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে (সোমবার) ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ১৬ হাজার ৫৮৫টি মামলা দেওয়া হয়েছে। এসময় ৬ কোটি ৭২ লাখ ৮৫ হাজার ৩৭৫ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত অবৈধ ব্যাটারিচালিত ৬৪ হাজার ৫৭২টি রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করেও কেন যানজট নিরসন করা যাচ্ছে না?
খোন্দকার নজমুল হাসান: রাজধানী ঢাকার যানজটের সমস্যা অনেক পুরোনো। এটা পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভব নয়। কেননা একটি আদর্শ শহরের জন্য ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকা প্রয়োজন। সেখানে আমাদের আছে প্রায় ৭-৮ শতাংশ। এরমধ্যেও ফুটপাত দখল, সড়কে পার্কিংসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় পুরো রাস্তা ব্যবহার করা যায় না। যানজট নিরসনে গত দুই মাসে আমরা অসহনীয় থেকে কম অসহনীয়তে আসতে পেরেছি। তবে সবাই যদি সচেতন হয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে চালক, যাত্রী এবং পথচারীরা আইন মেনে চলেন; তাহলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও যানজট সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব।
বাংলা ট্রিবিউন: সড়কে কারা বেশি আইন ভঙ্গ করছে এবং যানবাহনের ক্ষেত্রে কাগজপত্রে সমস্যা কাদের বেশি পাচ্ছেন?
খোন্দকার নজমুল হাসান: ট্রাফিক আইন ভঙ্গে শীর্ষে আছে বাস ও মোটরসাইকেল চালকরা। আর বাসের কাগজপত্রের বেশি সমস্যা পাওয়া যায়। বাসের কাগজপত্র সমাধানে আমরা বাসগুলোকে অর্ডারে আনার চেষ্টা করছি। সিটির বাসগুলো কোম্পানিতে আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এতে করে বাসগুলো শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসবে। তবে ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের মধ্যে আরেকটি শ্রেণি আছে। সেটা হলো পথচারী। তারা রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করেন না। এমনকি ট্রাফিক সিগন্যালও মানেন না। পথচারীরা চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পারাপার হন।
বাংলা ট্রিবিউন: ফুটপাত দখল ও রাস্তায় পার্কিং মুক্ত করতে আপনাদের পদক্ষেপ কী?
খোন্দকার নজমুল হাসান: ঢাকার যে পরিমাণে হাই-রেজ ভবন রয়েছে। সে তুলনায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। যেমন ধরুন, রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে প্রতিদিন গাড়ি আসে প্রায় ২ হাজার গাড়ি আসে। অথচ তাদের গাড়ি পার্কিংয়ের ধারণ ক্ষমতা আছে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাধিক। বাকি গাড়িগুলো রাস্তায় পার্কিং করে রাখা হচ্ছে। ঠিক একইভাবে বাস টার্মিনালগুলোতে যে পরিমাণে বাস চলাচল বলে তার অর্ধেকও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই।
এমন পরিস্থিতি পুরো ঢাকা সিটিতে। আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করছি। চেষ্টার করছি ধীরে ধীরে পার্কিংয়ের সমস্যা দূর করতে। তবে এটা এখনই সম্ভব নয়। আমরা বলছি প্রয়োজনে কিছু সড়কে এক লাইনে গাড়ি পার্কিং হোক। কিন্তু পুরো রাস্তাজুড়ে না। রাস্তা দখলমুক্ত রাখলে যানজট হবে না। যানবাহন চলমান থাকতে হবে।
এছাড়াও ফুটপাত দখল থাকলে মানুষ সড়কে চলাচল করে। এটাও যানজটের আরেকটি কারণ। যার ফলে আমরা প্রতিনিয়ত ফুটপাত দখল মুক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করছি। তবে এটা প্রধানত পুলিশের ক্রাইম বিভাগ ও সিটি করপোরেশনের কাজ। ফলে সবার সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত রাখা সম্ভব।
বাংলা ট্রিবিউন: সিটির বাসগুলো স্টপেজে না দাঁড়িয়ে ইন্টারসেকশনে যাত্রী ওঠানামা করে এবং বাসে বাসের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আপনাদের ভূমিকা কী?
খোন্দকার নজমুল হাসান: ডিএমপিতে ১৬৯টা যাত্রী ছাউনি, বাস বে অথবা বাস স্টপেজ আছে। পর্যায়ক্রমে আরও হবে। আমরা বাস মালিক ও চালকদের সঙ্গে বসেছি। তাদের আমরা অনুরোধ করেছি, যেন বাসগুলো ইন্টারসেকশনে না দাঁড়িয়ে বাস স্টপেজে দাঁড়ায়। এটা হয়ত দুই-পাঁচদিনে হবে না। তবে আমরা আশা করছি দুই মাসের মধ্যে একটা ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে ইন্টার-সেকশনে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা ও বাসে বাসে প্রতিযোগার জন্য আমরা ব্যবস্থাও নিচ্ছি। গত এক মাসে যতগুলো মামলা হয়েছে, তার অর্ধেকই বাসের বিরুদ্ধে।
বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশায় সয়লাব। সরকার কর্তৃক তাদের চলার কোনও অনুমোদন নেই। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের উদ্যোগ কী?
খোন্দকার নজমুল হাসান: ব্যাটারিচালিত রিকশা খুবই ভয়ংকর একটি যান। হালকা বাহনে দ্রুত গতি। এটার কারণে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা প্রতিনিয়ত ব্যাটারি চালিত রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রধান সড়কে উঠলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৫৭২টি ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এটা বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে। বিশেষ করে যারা এ রিকশার যন্ত্রাংশ আনে (আমদানি করেন)... এটা যদি অবৈধ হয়, তাহলে আমি তাদের লাইসেন্স দিচ্ছি কেন? যেখানে তারা ব্যাটারির চার্জ দিচ্ছে, সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হোক। তাহলে হয়তো বন্ধ করা সম্ভব।
বাংলা ট্রিবিউন: যানজটের অন্যতম কারণ অতিরিক্ত সিগন্যাল। সিগন্যাল কমিয়ে আনার উপায় কী?
খোন্দকার নজমুল হাসান: সাধারণত একটি আদর্শ সিগন্যাল হওয়া উচিত অন্তত এক কিলোমিটার দূরত্বে। অথচ আমাদের দুইশ মিটারের মধ্যে দুটি সিগন্যাল আছে। এক্ষেত্রে আমরা যতই এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে সিগন্যালকে আধুনিকায়ন করি লাভ হবে না। এজন্য আমরা বুয়েটের সঙ্গে যৌথভাবে একটা কাজ করছি। ছয়টি পয়েন্টের মধ্যে একটি হলো ট্রাফিক ল্যাম্প-পোস্টের মাধ্যমে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা। তখন সবাই লাল ও সবুজ লাইট দেখে চলাচল করবে। সেক্ষেত্রে আমরা একসঙ্গে একাধিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।
বাংলা ট্রিবিউন: ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বুয়েটের সঙ্গে যে কাজ করছেন, সেখানে কী কী বিষয় থাকছে এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কেমন পরিবর্তন ঘটবে বলে ধারণা করছেন?
খোন্দকার নজমুল হাসান: বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞা টিমের সহযোগিতায় যানজট নিরসনে একটি পাইলট প্রজেক্ট বাস্তবায়নের কাজ চলছে। পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা একটি রাস্তার সমস্যা সমাধান করে অন্যান্য রাস্তাগুলো সেভাবে সমাধান করবো। পাইলট প্রজেক্টের আওতায় প্রথম ধাপে হাইকোর্ট মোড় থেকে কাকরাইল, শাহবাগ, সোনারগাঁও ক্রসিং, জাহাঙ্গীর গেইট, বানানী হয়ে আব্দুল্লাপুর পর্যন্ত। এরমধ্যে ২৯টি সিগন্যাল পয়েন্টে রয়েছে। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে সিগন্যালগুলো ল্যাম্প-পোস্টের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা, ইন্টারসেকশনের বা রাস্তার মোড়ের ১০০ মিটারের মধ্যে যেন কোনো যানবাহন না দাঁড়ায়, বাস স্টপেজে ছাড়া যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করা এবং একটি মোবাইল টিম কাজ করবে। সিটি করপোরেশন, পুলিশ ও ডিটিসিএ প্রতিনিধিরা থাকবে। ডিটিসিএ একজন ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার থাকবে, সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি রাস্তার কোনো সমস্যা আছে কিনা তা দেখভাল করবে, আর পুলিশের ইনফোর্সমেন্ট ঠিক মতো হচ্ছে কিনা এটা দেখবে পুলিশ প্রতিনিধি। এই ভ্রাম্যমাণ টিম সার্বক্ষণিক ঘুরে ঘুরে মনিটরিং করবে।
বাংলা ট্রিবিউন: সড়কে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কি ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
খোন্দকার নজমুল হাসান: আমাদের শহরের রাস্তায় অতিরিক্ত ধুলাবালি, গাড়ির কালো ধোয়া ও দূষিত বায়ুর কারণে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের অ্যাজমা ও হার্টের রোগ বেশি হচ্ছে। এছাড়াও শব্দদূষণের কারণে বধিরতায় ভোগেন বেশিরভাগ পুলিশ সদস্য। আমাদের পুলিশ সদস্যদের রোদ, বৃষ্টি এমনকি প্রচণ্ড খড়ার মধ্যেও কাজ করতে হয়। সড়কে ঘন ঘন খোড়াখুড়ি, ধুলাবালি এবং যানবাহনগুলো নিয়ম শৃঙ্খলা মধ্যে আসলে এসব সমস্যা অনেকটা কমে আসবে। ট্রাফিক পুলিশের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে আলাদা করে কোনও ব্যবস্থা নেই। তবে পুলিশ সদস্যদের বিনামূল্যে চিকিৎসা নেওয়া জন্য ঢাকায় একটি পুলিশ হাসপাতাল আছে। সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
বাংলা ট্রিবিউন: অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশসহ জরুরি প্রয়োজনে জন্য ইমার্জেন্সি কোনও লেন করা হবে কিনা?
খোন্দকার নজমুল হাসান: অনেক সময় দেখা যায়, পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্স উলটো পথে যাচ্ছে। এটা আমাদের আইনের বিধানেও আছে। জরুরি প্রয়োজনে যেতে পারে। তবে দেখা গেছে, ঢাকা যে পরিমাণে সাধারণ যানবাহন চলাচল করে তার তুলনায় ইমার্জেন্সি যানবাহন খুবই সামান্য। বর্তমানে আমাদের রাস্তা কম থাকায় আলাদা করে ইমার্জেন্সি লেন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তবে নতুন প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা যদি ইন্টারসেকশনগুলো চলমান রাখতে পারি। তাহলে আর ইমার্জেন্সি লেনের দরকার হবে না। তখন অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সাংবাদিকসহ সবাই তাড়াতাড়ি যেতে পারবে।
বাংলা ট্রিবিউন: শব্দদূষণ রোধে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা কী?
খোন্দকার নজমুল হাসান: ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আইনে বিধি ৮৮ এর শব্দদূষণ একটি অপরাধ। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা স্পট ফাইন করতে পারি না। ১১৩ ধারায় বলা আছে, আমরা ৯টা সেকশনে (ধারায়) মামলা বা জরিমানা করতে পারবো। কিন্তু ১১৩ ধারায় ৮৮ ধারা যুক্ত নাই। আমরা অনেকবার বলেছি, এই ধারাটা যদি একটু সংশোধন ১১৩ এর মধ্যে যুক্ত করে দেওয়া হয়। যাতে ৯টি স্পট ফাইনের জায়গায় ১০টি স্পট ফাইন করা হয়। তাহলে অযথা, অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত হর্ন বাজিয়ে শব্দ দূষণের কারণে আমরা জরিমানা করলে এটা কমে আসবে।
বাংলা ট্রিবিউন: যানবাহন চলাচলে সড়ক বিভাজন বা আলাদা লেন করা হবে কিনা?
খোন্দকার নজমুল হাসান: ঢাকা একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহর। রাস্তার তুলনায় যানবাহন বেশি। শহরের অলিগলির যানবাহন যদি প্রধান সড়কে চলে আসে, তাহলে যানজট বাড়ে। দেখা গেছে পাঁচটা রিকশার পিছনে যদি একটি বাস থাকে। তাহলে ওই বাসটি রিকশার গতিতেই চলতে হবে। এমনকি মূল সড়কে থ্রি হুইলার যানবাহনও চলা উচিত নয়। আমাদের ট্রাফিক বিভাগের জনবল আছে। আমরা যদি শুধু ইনফোর্সমেন্ট করি, তাহলে যথেষ্ট। কিন্তু আমরাতো শুধু ইনফোর্সমেন্ট করছি না, আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিংও করতে হয়। ট্রাফিক লাইটের কাজ করতে হয়, হাত দিয়ে গাড়ি থামাতে হয়। আমাদের কাজ হলো ইন্টারসেকশনে দাঁড়িয়ে লাইটে গাড়ি চলবে, আবার লাইটে গাড়ি দাঁড়াবে। এর মাঝখানে কোনও গাড়ি আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।