ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচনি পুরো ব্যবস্থাই পর্যালোচনা করবো। পর্যালোচনা করে জানাবো। নির্বাচন কমিশনের যে আইন আছে, এর মাধ্যমে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তারা পক্ষপাতযুক্ত ছিলেন। নির্বাচন কমিশনের এসব ত্রুটি চিহ্নিত করে সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাব দেবো।’
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি কমিশনের সম্ভাব্য কার্যক্রম, সদস্য সংখ্যা, স্থায়ী নির্বাচন ব্যবস্থাসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন।
অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা, নির্বাচন ও নির্বাচনি সংস্কারের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরব ভূমিকা রেখেছেন। ২০০২ সাল থেকে নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক হিসেবে আছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য গত ১১ সেপ্টেম্বর সংবিধানসহ জাতীয়ভিত্তিক কিছু সংস্কারের সিদ্ধান্ত জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছয়টি কমিশন গঠন করেন। এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে বদিউল আলম মজুমদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক মজুমদার কয়েকটি বিষয়ে আলাপ করেন। কথোপকথনটি নিচে তুলে ধরা হলো।
বাংলা ট্রিবিউন: অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের নেতৃত্ব দেবেন আপনি। এই কমিশনের সদস্য কতজন হতে পারে?
বদিউল আলম মজুমদার: এখনও এটা আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে আছে। আশা করি এই মাসের (সেপ্টেম্বর) মধ্যেই এটা ঠিক হবে। ৮-১০ জন সদস্য হতে পারে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি দীর্ঘদিন ধরে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে কমিশনের কাজে ‘সুজনের’ প্রস্তাব বা ভূমিকা কেমন থাকতে পারে।
বদিউল আলম মজুমদার: আমি তো একা নই, আমাদের পুরো কমিশন এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করবে। অন্যদের অভিজ্ঞতা, অন্য দেশের অভিজ্ঞতা, আমাদের আইন-কানুন, নির্বাচন পদ্ধতি— সব বিচার-বিশ্লেষণ করে তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নেবো।
বাংলা ট্রিবিউন: কমিশনের কার্যালয় কী ঠিক হয়েছে?
বদিউল আলম মজুমদার: না, এখনও এটা ঠিক হয়নি।
বাংলা ট্রিবিউন: বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। আপনি নিজেও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এক্ষেত্রে কমিশনকে শক্তিশালী করতে আপনার কী চিন্তা?
বদিউল আলম মজুমদার: আমরা পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাই পর্যালোচনা করবো। নির্বাচন কমিশনের আইনে কী আছে, পর্যালোচনা করবো। এরপর সিদ্ধান্ত দেবো। নির্বাচন কমিশনের যে আইনটা আছে, এর মাধ্যমে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা পক্ষপাতযুক্ত ছিলেন। নির্বাচন কমিশনের ত্রুটি চিহ্নিত করে আমরা আমাদের প্রস্তাব দেবো।
বাংলা ট্রিবিউন: সংস্কার প্রস্তাবের পর বাস্তবায়নের বিষয়টি কীভাবে হতে পারে?
বদিউল আলম মজুমদার: এটা সরকার করবে, যেগুলো গ্রহণ করবে সেগুলো ইমপ্লিমেন্টেশনের (প্রয়োগ) উদ্যোগ নেবে। এবং তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও এগুলো নিয়ে সংলাপ করবে। সংলাপের পর সিদ্ধান্ত নেবে।
বাংলা ট্রিবিউন: কমিশন কী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনও সংলাপ করবে?
বদিউল আলম মজুমদার: রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমরা সরাসরি সংলাপ করবো না। এটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই করবে। আমরা তাদের প্রস্তাব দেবো।
বাংলা ট্রিবিউন: প্রার্থীদের ব্যয়, প্রচারণার খরচ এসব নিয়ে আপনিও নানান সময়ে কথা বলেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও এ ক্ষেত্রে ন্যায্যতার প্রশ্ন তুলেছে। এ বিষয়গুলো কি সংস্কারের অংশ হবে?
বদিউল আলম মজুমদার: এসব আমরা পর্যালোচনা করছি। একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন করার জন্য যা প্রয়োজন—আমরা প্রস্তাব করবো।
বাংলা ট্রিবিউন: স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার ও গণভোট নিয়ে কমিশন কোনও চিন্তা করছে?
বদিউল আলম মজুমদার: স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও পর্যালোচনা করে আমাদের সুপারিশ থাকবে। কিন্তু গণভোটের বিষয়টি সংবিধান সংক্রান্ত কমিশনের, এটা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: অনেক রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব রয়েছে—ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ রাখা। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
বদিউল আলম মজুমদার: এই বিষয়টিও সংবিধান সংস্কার-বিষয়ক কমিশনেরই এখতিয়ার হবে। এবং তারা যদি এটা গ্রহণ করে, তাহলে সে ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: ব্যালট ও ইভিএম—ভোট গ্রহণের এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে কোনটিকে কমিশন গুরুত্ব দেবে?
বদিউল আলম মজুমদার: ইভিএম তো বিতর্কিত হয়েছে। ইভিএম যদি গ্রহণ করতে হয়, তাহলে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
বাংলা ট্রিবিউন: ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইভিএম প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা আছে কি?
বদিউল আলম মজুমদার: এটা রাজনীতিবিদরা ঠিক করবেন, পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে। আমরা প্রযুক্তির ব্যাপারে পর্যালোচনা করবো। আমরা সুপারিশ করবো, কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কেউ নই।
বাংলা ট্রিবিউন: নির্বাচন কমিশন গঠনে বাছাই কমিটির বিষয়ে আপনার চিন্তা কী?
বদিউল আলম মজুমদার: এগুলো আমরা যখন পর্যালোচনা করবো, তখন এসব বিবেচনায় নেবো। কীভাবে নিরপেক্ষ এবং সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায়, সে ব্যাপারে আমরা কাজ করবো।
বাংলা ট্রিবিউন: মোটা দাগে সংস্কারের জায়গাগুলো কী হতে পারে বলে মনে করেন?
বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচনি ব্যবস্থা সংক্রান্ত সব বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো, খতিয়ে দেখবো। আপনার প্রশ্নের ভেতরে এরইমধ্যে প্রসঙ্গগুলো উঠে এসেছে, এসব তো আলোচনা হবেই। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার পর আমরা সুপারিশ করবো।
বাংলা ট্রিবিউন: আমাদের আশপাশের রাষ্ট্রগুলোতে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি সেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার বিষয়টি লক্ষ করা যায়। আমাদের এখানে নির্বাচন নিরপেক্ষ পদ্ধতি নাকি দলীয় সরকারের অধীনেই হতে পারে?
বদিউল আলম মজুমদার: এটাও সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের এখতিয়ার। বিষয়টি তারাই দেখবেন।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার নেতৃত্বাধীন কমিশনের সদস্য কারা হবেন, কারা কারা থাকছেন প্রাথমিকভাবে কি বলা যাবে?
বদিউল আলম মজুমদার: না, এখনও বলার সময় আসেনি।