এম ইউ গ্রিন, সুন্দরবনের প্রথম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা তিনি। ইংরেজ শাসন আমলে ১৮৮৪ সালে তিনিই সুন্দরবনের প্রথম বন কর্মকর্তার দায়িত্ব পান। অনেকে শুনলে অবাক হবেন এর আগে সুন্দরবন রক্ষায় কোনও বন কাঠামো ছিল না। কালের বিবর্তনে মানুষের আশঙ্কা মানুষের আগ্রাসনে গ্রিনের সেই সুন্দরবন কি সবুজ হারাচ্ছে?
সবুজ রক্ষার দাবিতে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হলেও রাষ্ট্রীয় অবহেলার অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। সুন্দরবন ধ্বংসের সব চেয়ে বড় প্রকল্প রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার দাবিতে গত সরকারের সময় যেমন আন্দোলন হয়েছে এখনও তা চলমান। সাবেক সরকার যেমন পরিবেশবাদিদের চরম প্রতিবাদের মুখে জোর করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে সেই চুক্তি বাতিলের বিষয়ে বর্তমান সরকারেরও কোনও আগ্রহ নেই। এমন এক পরিস্থিতিতে দেশে পালিত হতে যাচ্ছে সুন্দরবন দিবস। এবারের সুন্দরবন দিবসের মূল শ্লোগান, রামপালসহ সুন্দরবন বিনাশী সব প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
ইতিহাস
২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশের উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই প্রতি বছর দেশে সুন্দরবন দিবস পালিত হয়ে আসছে।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আগেই জানিয়েছেন এ ধরনের চুক্তি বাতিল করা সম্ভব নয়। চুক্তি বাতিলকে একটি জটিল প্রক্রিয়া বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের দাবি জানিয়ে সম্প্রতি মানববন্ধন করেছে খুলনার সংগঠন কৃষি-শিল্প-পাট ও পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক কমিটি। দক্ষিণের জেলা খুলনায় আয়োজিত ওই মানববন্ধনে স্থানীয়রা দাবি করেছেন রামপাল চালুর পর থেকে বর্জ্য পানিতে ছেড়ে দেওয়াতে মাছ কমতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) প্রথম থেকেই রামপাল বন্ধের দাবি করে আসছে। আজও তাদের দাবি এটাই। কেননা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পরপরই এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামী ২০ বছর ধরে এমন বিধ্বংসি একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে বলে তারা মনে করা হচ্ছে।
সাধারণ তথ্য
ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। বনের ওপর মানুষের অধিক চাপ ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত করেছে। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্বাধীকার অর্জন করে। এল টি হজেয ১৮২৯ সালে সুন্দরবনের প্রথম জরীপ পরিচালনা করেন। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং ১৮৭৯ সালে সমগ্র সুন্দরবনের দায় দায়িত্ব বন বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা হয়। নাম তিনি ১৮৮৪ সালে সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ৬ হাজার ০১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে পড়ে, যা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ৪ দশমকি ২ শতাংশ এবং সমগ্র বনভূমির প্রায় ৪৪ ভাগ।
কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন বলছে ১৯৬৭ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। ২০০১ সালে আয়তন কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটারে। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন ছিল ১১ হাজার ৪৫৩ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫১ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে।
অর্থাৎ সুন্দরবন থেকে ক্রমেই সবুজ উধাও হয়ে সেখানে মানুষের বসতি আর বাণিজ্য সম্প্রসারণ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী কয়েকশ’ বছর পর সুন্দরনের অস্তিত্ব আর টিকে থাকবে কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
বাপার সভাপতি নূর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, সুন্দরবন বিধ্বংসী সব প্রকল্প বাতিল করতে হবে। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও বিকল্প নেই। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে সব প্রকল্প বাতিল করতেই হবে। এখনকার সরকার না পারলে নির্বাচিত সরকারের কাছেও আমরা একই দাবি জানিয়ে যাবো।
ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলে আসছিলাম সুন্দরবনের আশেপাশে কোনও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত হবে না। এতে বনের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। আমাদের প্রতিবাদের মুখেই আগের সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কিছু প্রকল্পের অনুমতি দেয়। যার ফলশ্রুতিতে এখন সুন্দরবনের পরিবেশ দুষণ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এইভাবে চলতে থাকলে আমরা আমাদের সুন্দরবনকে ধ্বংসের পথেই ঠেলে দেবো।
কর্মসূচি
সুন্দরবন দিবস-২০২৫ পালন উপলক্ষে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) উদ্যোগে ১৪ ফেব্রুয়ারি সাড়ে ১০টায় জাতীয় জাদুঘরের সামনে, শাহবাগ, ঢাকায় সুন্দরবন বিনাসী গৃহীত সব প্রকল্প বন্ধের দাবিতে এক নাগরিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।
এদিকে ‘সুন্দরবন আমার মা, ধ্বংস হতে দেবো না’ এই শ্লোগানকে ধারণ করে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা), সুন্দরবন রক্ষায় আমরা, পশুর রিভার ওয়াটারকিপার এবং স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর যৌথ আয়োজনে আজ সুন্দরবন দিবস উপলক্ষে মোংলায় দিনব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এম ইউ গ্রিন সুন্দরবনের প্রথম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা তিনি। এই তথ্যটি জানা যায়, খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সুন্দরবনের যে ইতিহাস উল্লেখ করা আছে সেখানে।