রাজধানীতে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করছে, বিভিন্ন এলাকায় সেই পানি ঘোলা ও দুর্গন্ধযুক্ত। এমনকি পানিতে থাকে ময়লা ও পোকামাকড়। রান্না, গোসল, খাওয়াসহ দৈনন্দিন কাজে এসব ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি ব্যবহারে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা।
ওয়াসার এমন পানি নিয়ে রাজধানীর জুরাইন এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তির শেষ নেই। বহুদিন ধরে চলা এই সমস্যার সমাধান কোনোভাবেই পাচ্ছেন না এই এলাকার বাসিন্দারা। বিকল্প পন্থা হিসেবে স্থানীয় মসজিদগুলোর গভীর নলকূপই এখন তাদের ভরসা।
সরেজমিন দেখা গেছে, পূর্ব জুরাইনের ইসলামাবাদ মসজিদের গভীর নলকূপ ঘিরে বোতল, কলসি হাতে পানির জন্য লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। তারা জানান, ওয়াসার পানি খাওয়ার অনুপযোগী হওয়ায় মসজিদের পানিই একমাত্র ভরসা।
পূর্ব জুরাইনের বাসিন্দা আসাদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিরাপদ পানির সংকটে জুরাইনের মানুষ। বছরের পর বছর পানির সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলেও দায়িত্বশীলরা এর সমাধানে কোনও উদ্যোগ নেননি, আমাদেরও দুর্ভোগ কমেনি।’
পূর্ব জুরাইনের আরেক বাসিন্দা তুহিন মাহমুদ আক্ষেপ করে বলেন, “ওয়াসার পানি কতটুকু ‘জীবন’ হতে পেরেছে মানুষের! কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব কতটুকু সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছে? কবে নাগাদ ওয়াসা সাধারণ মানুষকে সঠিক সেবা দিতে সক্ষম হবে? এসব প্রশ্নের জবাব দরকার। শুধু শুধু সেবার নামে প্রতারণা জনগণ আর মেনে নেবে না।’
মসজিদের পানিই জুরাইনের বাসিন্দাদের ভরসা
পূর্ব জুরাইন এলাকায় মসজিদ কর্তৃপক্ষকে নামমাত্র টাকা দিয়ে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা এবং বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এলাকাবাসী পানি নিতে পারে। মসজিদে এক বোতল বা এক জগ পানি এক টাকা, পাঁচ লিটারের বোতল দুই টাকা, ১০ লিটারের বোতল বা কলসি তিন টাকা এবং জার ভরে পানি নিলে দিতে হয় পাঁচ টাকা।
জুরাইনের বাসিন্দাদের মতে, পানের অযোগ্য ওয়াসার পানির পরিবর্তে একযুগ ধরে এলাকাবাসীর জন্য মসজিদের পানি নিয়ামতস্বরূপ। মসজিদগুলো পানি না দিলে এলাকার মানুষের রান্নাবান্না, এমনকি খাবার পানি পাওয়ার কোনও উপায় থাকতো না বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে খাবার, রান্না, এমনকি গোসলের পানির কষ্টে ভুগতে হচ্ছে তাদের। অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে জুরাইনের বেশ কয়েকটি বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করছে, তা ঘোলা ও দুর্গন্ধযুক্ত, এমনকি ঘোলা পানির সঙ্গে আসছে পোকামাকড়।
শুধু জুরাইন নয়, ওয়াসার ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির এমন অভিযোগ কল্যাণপুর, তেজগাঁও, মালিবাগ, মধুবাগ, মগবাজার, খিলগাঁও, বাড্ডা, বাসাবো, মুগদা, মানিকনগর, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের।
কল্যাণপুরের বাসিন্দা ইফতেখার রাতুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওয়াসার পানির সমস্যার বিষয়ে আমরা কয়েক দিন পরপরই ফোন করে অভিযোগ জানাই। কিন্তু অভিযোগ কোনও কাজে আসে না। ওয়াসা থেকে বলা হয়, আমাদের পানির ট্যাংক পরিষ্কার করতে। ট্যাংক অপরিষ্কারের কারণে নাকি এমন গন্ধ আসে। অথচ আমাদের ট্যাংক একেবারেই পরিষ্কার।’
এই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘মাঝে-মধ্যে বেসিনে মুখ ধুতে গিয়ে পানির গন্ধে বমি চলে আসে। বলা চলে, দোকান থেকে কেনা পানি দিয়েই সব কাজ সারতে হয়। সময় যেহেতু পরিবর্তন হয়েছে, আমরা চাই ওয়াসাতেও পরিবর্তন আসুক। ওয়াসার কর্মকর্তাদের হুঁশ ফিরুক।’
ময়লা পানি ব্যবহারে বাড়ছে পানিবাহিত রোগ
ওয়াসার ময়লা পানি ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ। এর মধ্যে অন্যতম জুরাইনের ঋষিপাড়ার দেড় বছর বয়সী রাইসা। তার পুরো শরীরে চুলকানি, আর লাল গোটা। রাইসার পুরো পরিবার ভুগছে একই অসুখে।
রাইসার মা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওয়াসার পানি দিয়ে আমরা তেমন কিছুই করতে পারি না। মাঝে-মধ্যে গোসল করি। মসজিদ থেকে সরবরাহ করি রান্না আর খাওয়ার পানি। গত পরশু রাইসাকে গোসল করানোর পরে চুলকানি হচ্ছে শরীরে। ওষুধ খাওয়ালাম, কিন্তু কমছে না।’
চিকিৎসকরা বলছেন, দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসসহ নানা ধরনের চর্ম রোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ঝুঁকি বেশি।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের মেডিসিন ও স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ আফতাব রাসেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দূষিত পানি ব্যবহারে শিশুদের বেশি সমস্যা হয়। এছাড়া বয়স্ক মানুষ এতে আক্রান্ত হতে পারে। দূষিত পানির ফলে ডায়রিয়াজনিত রোগ ও পানিবাহিত রোগ বাড়ে। চর্ম রোগসহ দীর্ঘমেয়াদি ক্রনিক রোগ হতে পারে।’
যা বলছে ওয়াসা
পানিতে দুর্গন্ধ, ময়লা ও পোকামাকড়ের বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা ওয়াসার এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজধানীতে জরুরি পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় ৩৮৮টি গভীর নলকূপ প্রতিস্থাপন করবে ঢাকা ওয়াসা। সে লক্ষ্যে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি ঢাকা শহরে জরুরি পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় ৩৮৮টি গভীর নলকূপ প্রতিস্থাপন কাজের প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করবে। ফলে যেসব এলাকায় পানির সংকট বেশি, সেখানে কিছুটা হলেও সমস্যা নিরসন হবে।’
কবে নাগাদ গভীর নলকূপ প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রতিস্থাপনযোগ্য গভীর নলকূপের তালিকা ও উৎপাদন সাইটে সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেবে কমিটি। পরে কমিটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সেখানে নলকূপ স্থাপন করা হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব এলাকায় পানির সমস্যা বেশি সেসব এলাকা গুরুত্ব পাবে।’
ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শহীদ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জুরাইন-মুরাদপুরের পানি সরবরাহ লাইন অনেক পুরোনো। পানির লাইনগুলো মাটির অন্তত ২০ ফুট নিচে পড়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে পাইপ ছিদ্র হয়ে গেছে, যেখান দিয়ে নোংরা পানি ঢুকে পড়ছে। এ কারণে বাসাবাড়ির কলে দুর্গন্ধযুক্ত ও ময়লা পানি আসছে।’
ছিদ্র লাইন ঠিক করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পুরো লাইনটাই ছিদ্র হয়ে গেছে। কত জায়গায় ঠিক করবো? নতুন লাইন বসলে পানিতে আর দুর্গন্ধ থাকবে না। নতুন লাইন বসানোর উদ্যোগ ওয়াসা থেকে অনেক আগেই নেওয়া হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে আর বাসাবাড়ির পানিতে গন্ধ থাকবে না।’