যুক্তরাজ্যে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসহ বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে এক নীরব সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। সম্প্রতি এক জাতীয় পরিসংখ্যানে দেশটির সামগ্রিক মাদক সমস্যার চিত্র ফুটে উঠেছে। এই পরিসংখ্যান আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতসহ দক্ষিণ এশীয় নারীদের মাদকাসক্তির হার ক্রমেই বেড়েছে।
বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগী, মাদক-সংশ্লিষ্ট মৃত্যু এবং পাঁচ বছরে মাদক ব্যবহারের পরিবর্তনের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গবেষণা চালিয়েছে ‘ড্রাগ টেস্টিং কিটস ইউকে’। গবেষণা প্রতিবেদনে এই সমস্যার তীব্রতা ফুটে উঠেছে। দেশটির জাতীয় তথ্যে উত্তর-পশ্চিম, উত্তর-পূর্ব এবং ইয়র্কশায়ারের মতো অঞ্চলগুলোকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে পূর্ব লন্ডন যেখানে বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের বসবাস বেশি, সেখানে বিশেষ করে নারীদের মাদক-সংশ্লিষ্টতা বিশেষভাবে গুরুত্বের দাবি রাখে।
যদিও গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয়ভাবে পুরুষদের মাদক-সম্পর্কিত সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তির হার নারীদের তুলনায় এখনও অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উত্তর-পশ্চিমে, যেখানে প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যায় ১৮ জন মাদক-সম্পর্কিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হন, সেখানে পুরুষদের ভর্তির সংখ্যা নারীদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ (পুরুষ ৯৬৫, নারী ৩৫০)।
ইয়র্কশায়ার এবং হাম্বারেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়, যেখানে পুরুষদের ভর্তির সংখ্যা নারীদের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। তবে, পূর্ব লন্ডনের দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়গুলোতে, বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেটে যেখানে ব্রিটেনের সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি বসবাস করেন, সেখানে নারীদের মাদকাসক্তির কারণগুলো আরও জটিল। সাংস্কৃতিক কুসংস্কার, ভাষার প্রতিবন্ধকতা এবং সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল সহায়তা পরিষেবার সীমিত প্রাপ্যতা এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। সেখানে সামগ্রিকভাবে লন্ডনে প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যায় ১৩ জন মাদক-সম্পর্কিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং গত পাঁচ বছরে মাদক ব্যবহারের হার ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে দক্ষিণ এশীয় নারীদের বিশেষ সংগ্রামগুলো এই তথ্যে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না।
‘ড্রাগ টেস্টিং কিটস ইউকে'র গবেষণায় আরও দেখা গেছে, উত্তর-পূর্বে মাদক-সম্পর্কিত মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি (প্রতি মিলিয়নে ৮৭.৩ জন) এবং ইয়র্কশায়ার ও হাম্বারে গত পাঁচ বছরে মাদক ব্যবহারের হার ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কোম্পানির বিক্রয় পরিচালক জেমস গুন্টার শিল্প পতনের সঙ্গে মাদক ব্যবহারের সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন, যা পূর্ব লন্ডনের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তবে, দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়, বিশেষ করে নারীরা, অতিরিক্ত বোঝা বহন করে, সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা, পারিবারিক চাপ এবং সাংস্কৃতিকভাবে উপযুক্ত মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার সীমিত প্রাপ্যতা।
এই চ্যালেঞ্জ কেবল চিকিৎসাগত নয়, বরং গভীরভাবে সামাজিক। দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মাদকাসক্তি নিয়ে কুসংস্কার প্রায়শই নারীদের সাহায্য চাইতে বাধা দেয়। ভাষার প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান সংস্থানগুলোতে প্রবেশাধিকার সীমিত করে। এই সম্প্রদায়গুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট গবেষণা এবং ডেটা সংগ্রহের অভাব সমস্যার প্রকৃত পরিধিকে অস্পষ্ট করে তোলে। তাই, দক্ষিণ এশীয় নারীদের বিশেষ চাহিদা অনুযায়ী সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল হস্তক্ষেপ কৌশল, সম্প্রদায় সম্পৃক্ততা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা জরুরিভাবে প্রয়োজন। এই নীরব সংকটকে উপেক্ষা করলে দুর্দশার চক্র চলতে থাকবে, যা একটি দুর্বল জনগোষ্ঠীকে আরও প্রান্তিক করে তুলবে।
যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায়গুলোতে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা দিয়েছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ, এমনকি অপ্রাপ্তবয়স্করাও সিনথেটিক গাঁজাযুক্ত ‘উইড ভ্যাপের’ প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। আকর্ষণীয় স্বাদ এবং প্রতারণামূলক লেবেলিং দিয়ে বাজারজাত করা এই সহজলভ্য ডিভাইসগুলো শক্তিশালী এবং অপ্রত্যাশিত নেশা তৈরি করে, যা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা এবং নির্ভরতার দিকে নিয়ে যায়।
গোপন সেবন এবং আপাত নিরীহতার আকর্ষণ উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিগুলোকে আড়াল করে, কারণ সিনথেটিক ক্যানাবিনয়েড সাইকোসিস, খিঁচুনি এবং দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে। এই ক্রমবর্ধমান সংকট জরুরি হস্তক্ষেপের দাবি জানায়, যার মধ্যে রয়েছে লক্ষ্যযুক্ত শিক্ষা প্রচারণা, ভ্যাপ পণ্যগুলোর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং এই দুর্বল জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি হওয়া অনন্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল সহায়তা পরিষেবা।
পূর্ব লন্ডনসহ ব্রিটেনজুড়ে বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশীয় নারীদের মাদক আসক্তির এ চিত্রে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন লন্ডনের ক্রয়োডন কাউন্সিলের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। মাদক যেন আমাদের নতুন প্রজন্মকে নীরবে ধ্বংস করতে না পারে, সেজন্য পরিবার, স্বজন ও সরকার সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই।