পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা উৎসব’ ছিল বাঙালির চিরায়ত একটি ঐতিহ্য। পুরোনো বকেয়ার হিসাব চুকিয়ে নতুন করে সম্পর্ক গড়ার দিন ছিল এটি। চিঠি দিয়ে ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টিমুখ করানোর রেওয়াজও বেশ পুরোনো। তবে আধুনিকতার এই যুগে টালি খাতার জায়গা দখলে নিয়েছে প্রযুক্তি। ভাটা পড়েছে হালখাতার কার্ড দেওয়ার রেওয়াজ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার ফলে খাতার হিসেবের রেওয়াজে ভাটা পড়েছে। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে শতবর্ষী এই ‘হালখাতা উৎসব’। কমেছে উৎসবমুখরতা। গুটিকয়েক দোকানে এ বছর হালখাতা করলেও নেই আগের মতো পুরোনো জৌলুস।
সরেজমিনে পুরান ঢাকার বাংলাবাজার, শাঁখারীবাজার ও তাঁতীবাজারে জুয়েলারি দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, সেসব দোকানে আগের মতো নেই হালখাতা উৎসবের আমেজ। তবে এখনও কিছু কিছু জায়গায় ব্যবসার হিসাবপত্র খাতাতেই হয়ে থাকে। তাতে হিসাব রাখতে ও বোঝাতে সুবিধা হয়।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন সবাই নগদ টাকায় কেনাকাটা করেন। বাকি বেচাকেনা, বন্ধক রাখা এসব গত কয়েক বছর ধরে বিলুপ্তপ্রায়। বকেয়া লেখার লাল কাপড়ের টালি খাতার ব্যবহার নেই বললেই চলে। হিসাব রাখা হয় মোবাইল ফোনের নোটপ্যাডে। তাই হালখাতার আয়োজন নেই।
শাঁখারি বাজার ও তাঁতীবাজারে লম্বা টানা পথের দুইপাশ দিয়ে সোনার দোকান। এখানে পাইকারি, খুচরা সোনা বেচাকেনাসহ সোনা বন্ধক রেখে টাকা ধার দেওয়া হয়। এখানকার প্রিন্স জুয়েলার্সের মালিক রতন কুমার সরকার (৪৫) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রতিবছরই হালখাতা করি কিন্তু দেখা যায় যাদের কাছে টাকা পাওয়া যায়, তারা হালখাতার দিন কম আসে, বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে ক্রেতা বিক্রেতার সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। টাকা দেওয়ার ভয়ে অনেকে হালখাতার দিন আসে না অন্য দিন আসে। এজন্য আগের মতো আর ঘটা করে হালখাতা করা হয় না। দেনাপাওনা এমনিতেই পরিশোধ হয়।
তাঁতীবাজারের নবরূপা জুয়েলার্সের মালিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নববর্ষের দিন মূলত ক্রেতা বিক্রেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করার দিন, কিছুটা সনাতনী ধর্মের ধর্মীয় বিশ্বাসও রয়েছে এখানে। এই দিনে কেউ কেনাকাটা বা বাকি পরিশোধ করলে তাকে মিষ্টি মুখ করানো হয়। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। এখন বাকি করলেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা হয়। হালখাতার চিঠির পরিবর্তে মোবাইলে খুদে বার্তা দিলেই হয়।
বাংলাবাজারের কার্ড ছাপানোর দোকানি শ্যামল চন্দ্র বলেন, বছর পাঁচেক আগেও পহেলা বৈশাখের সময় কার্ড ছাপানোর ব্যস্ততায় নিশ্বাস ফেলার সময় পেতাম না। পহেলা বৈশাখের এক সপ্তাহ আগেই কার্ড ছাপানোর অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিতাম। আর এখন হালখাতার কার্ডই কেউ ছাপাতে আসে না। এবার কার্ডের জন্য এখনও তেমন কোনও অর্ডার পাইনি। মাত্র দুইজন ব্যবসায় এসেছিল ১ হাজার কার্ড ছাপিয়েছে। হালখাতায় কার্ড ছাপানোর যে সংস্কৃতি ছিল তা এখন বিলুপ্তের পথে।
হালখাতার পুরানো ইতিহাস সম্পর্কে পুরান ঢাকার বাসিন্দা রমজান আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একটা সময় বৈশাখ এলে পাড়া মহল্লার প্রতিটি দোকানে হালখাতা আয়োজনের ধুম পড়তো। আমাদের কাছে এই দিনটি বিশেষ একটি দিন ছিল। টানা তিন দিন চলতো এই উৎসব। কিন্তু এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই উৎসব ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে।
হালখাতার রেওয়াজ কমলেও পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার মোড়ে এখনও লাল কাপড়ে বাঁধাই করা বাকির খাতার গুলো বিক্রি হতে দেখা যায়। অনেক ব্যবসায়ীকে এই নতুন খাতা সংগ্রহ করতে দেখা যায়। খাতা বিক্রেতা আশরাফ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, খাতা বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। আগের মত বিক্রি হয় না। তবুও ঐতিহ্য ধরে রাখতে অনেক ব্যবসায়ী এই খাতা খোঁজেন। তাই প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের আগে এই খাতা বিক্রি শুরু করি।
ঢাকার মধ্যে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারী বাজার, শ্যামবাজার, বাদামতলী, চকবাজার, ইসলামপুরের অনেক ব্যবসায়ীরা এখনও হালখাতা করেন। এসব জায়গায় পুরোনো ব্যবসায়ীরা এখনও নিয়ম করে নববর্ষে হালখাতা করেন।
শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল বাতেন জানান, আমাদের ব্যবসায়িক লেনদেন সবটাই খাতার মধ্যে। তাছাড়া আমাদের লাখ লাখ টাকার ব্যবসা। পুরানো ক্রেতারা সব সময় অর্ধেক টাকা দিয়ে মাল নেয়। এমন করে টাকা জমতে জমতে অনেক টাকা বাকি হয়ে যায়। সেটা আবার পহেলা বৈশাখে হালখাতা করে আমরা সেই টাকা নিয়ে থাকি। এটা আমরা বংশপরম্পরাই করে আসছি। এই রীতি রেওয়াজ আমরা এখনও পালন করি।