ইট-পাথরের দালান আর কাঁচে মোড়ানো জীবনের ছায়া পেরিয়ে, রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে হঠাৎই যেন নেমে এসেছে এক টুকরো গ্রামবাংলা। ব্যস্ত শহরের ক্লান্ত মুখগুলো হয়ে উঠেছে রঙিন, প্রাণবন্ত। এর কারণ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আয়োজনে গুলশান ২ এর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্কে চলছে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা ও নগর উৎসব।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) আয়োজনের দ্বিতীয় দিনে বাংলা নববর্ষের আনন্দে মুখরিত সেই পার্কে ভিড় জমিয়েছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কেউ এসেছেন প্রিয়জনের হাত ধরে, কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে, কেউ বা সন্তানদের নিয়ে নাগরদোলায় চড়তে। কূটনৈতিক অঞ্চল বলে ভিনদেশিরাও এসেছেন প্রাণের এই উৎসবে, চোখে-মুখে বিস্ময় আর আনন্দের মিশেল।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শহরের কাঠখোট্টা জীবন যেখানে কেবলই হিসাব আর দৌড়ের, সেই জীবন পেরিয়ে এই মেলাটি যেন খুলে দিয়েছে এক নতুন জানালা। এখানে নেই কনক্রিটের বন্দিত্ব, নেই করপোরেট ক্লান্তি, রয়েছে রঙতুলির ছোঁয়ায় আঁকা মুখ, পাড়াগাঁয়ের হস্তশিল্প আর লোকগানের সুর। আগত দর্শনার্থীরা বাঙালি সাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পার্কজুড়ে। উপভোগ করছেন মেলার নানা আয়োজন।
মেলায় রয়েছে- নাগরদোলা, শিশুদের জন্য দোলনা, আর ছবি আঁকার আয়োজন। দোকানগুলোতে সাজানো নানান পদের বাহার—কোনোটা মাটির কাজ, কোথাও কাঠের পুতুল, আবার কোথাও শাড়ি-কাপড়ের মেলা। রয়েছে নাগরিক বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
আগত দর্শনার্থীদের মাঝে উৎসব আমেজ আরও বাড়িয়ে তুলতে সকাল থেকে মঞ্চে শুরু হয় গানের কনসার্ট। শিল্পীদের কণ্ঠে ভেসে আসে মাটির গান, নদীর গান, মানুষের গান।
এর আগে সকালে শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে বের হয় বর্ষবরণের শোভাযাত্রা। মুখোশ, ঢাক, একতারা আর নানা রঙে রাঙানো সেই মিছিল যেন শহরের নীরব দেয়ালে প্রাণের শব্দ তুলে দেয়।
আগত দর্শনার্থীরা জানান, এই উৎসব কেবল আয়োজন নয়, এটি এক অন্বেষণ—নগরের কোলাহল পেরিয়ে বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি ছুঁয়ে দেখার প্রয়াস। গুলশানের এই আনন্দমেলা মনে করিয়ে দেয়, আমরা শহরে থাকি ঠিকই, তবে আমাদের হৃদয়ে এখনও বাজে পল্লীর বাঁশির সুর। করপোরেট-নগরীর হৃদয়েও যে বাংলা প্রাণ আছে, তা যেন নতুন করে প্রমাণ করে দিলো বৈশাখের এই উৎসব।
দেশে বেড়াতে এসেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিথিন আলম। এর আগে কখনও দেশে বৈশাখী উৎসবে আসেননি। এবার এসে খুব উচ্ছ্বাসিত। তিনি বলেন, ‘মেলা খুব ভালো লাগছে। সবাই সুন্দর পাঞ্জাবি পরেছে। বেশি ভালো লাগছে ওইটা (নাগরদোলা), নিজেরা বানিয়েছে, উঠে ভালো লেগেছে অনেক।’
উৎসবে আসা জার্মান নাগরিক ক্যাথরিন বাংলা সংস্কৃতির উষ্ণ অভ্যর্থনায় মুগ্ধ। তিনি বললেন, ‘চারপাশটা এত রঙিন! রঙের ছড়াছড়ি আর মানুষের মুখে হাসি—অসাধারণ। সবাই তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এসেছে, এটা আমার খুব ভালো লেগেছে। মনে হচ্ছে সবাই খুব আনন্দে আছে।’
এদিকে গুলশানেরই তরুণী মাইদা ইসলাম জানিয়েছেন তার উচ্ছ্বাসের কথা। তিনি বলেন ‘আয়োজনটা দারুণ। এত সুন্দর মেলা এত কাছেই—বেশিদূর যেতে হয়নি। ছবি তুলছি, ঘুরছি, মেলায় একটা অন্যরকম ফিল আছে। প্রতিদিন তো এমন পাওয়া যায় না, তাই খুব ভালো লাগছে।’