সম্প্রতি দেশে ধর্ষণসহ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের নিরাপত্তার ব্যবস্থার অবনতির কথাও উঠে এসেছে বিভিন্নমহল থেকে। গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজসহ ও দেশের বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের নেতারা। নারীর প্রতি এমন সহিংসতারোধে ‘হেল্প’ নামে একটি অ্যাপ চালু করা হয়েছে। যেখানে স্বেচ্ছাসেবীরাও কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
চলতি বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে গত ৫ মার্চ। ওইদিন দিবাগত রাতে মাগুরা সদরে বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার হন ৮ বছরের এক শিশু। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর সিএমএইচ হাসপাতালে মারা যায় সে। এঘটনার সময়সাময়িক আরও বেশ কিছু ঘটনার আলোচনায় আসে। গত ৯ মার্চ রাতে ঢাকার দক্ষিণ কেরানিগঞ্জে চার মাসের এক অন্তঃসত্তা নারীকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার নাম করে পানগাঁও ঋষিপাড়া এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে ডেকে নিয়ে কয়েকজন পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। পরে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়।
শুধু এ দুটি নয়, চলতি বছর এমন আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮৫টি। এর মধ্যে ধর্ষণের পর চার জনকে হত্যা করা হয়েছে। এক জন ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী রয়েছে। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিন জন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুই জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে।
এমন পরিস্থিতিতে সহিংসতা রোধে সম্প্রতি পুলিশের হটলাইন সেবার পাশাপাশি শর্টকোড চালুর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পুলিশের ডিজিটাইজেশনে সরকার যে চারটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে এই শর্টকোড চালুর সিদ্ধান্ত অন্যতম। তবে এসব উদ্যোগে সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি সংস্থাও।
দেশে নারীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রথবারের মতো এমন অ্যাপ চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার-বিজেসি ও সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন। পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে অ্যাপভিত্তিক পরিষেবা শুরুর দিকে শুধু গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলেও জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
নারীর প্রতি সহিংসতার কোনও ঘটনা এখন থেকে ‘HELP-হেল্প (হ্যারাসমেন্ট অ্যালিমিনেশন লিটারেসি প্রোগ্রাম)’ নামে একটি অ্যাপে লিপিবদ্ধ হলে তৎক্ষণাৎ সেটি ‘এফআইআর’ হিসেবে গণ্য হবে বলে জানিয়েছে ডিএমপি। এই অ্যাপে স্বেচ্ছাসেবীরাও কাজ করবেন বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
কীভাবে কাজ করবে 'হেল্প অ্যাপে’
‘হেল্প’ একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনভিত্তিক প্রকল্প, যা ঢাকা শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি কেবলমাত্র স্মার্ট ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীদের জন্য ডিজাইন করা। এর মাধ্যমে চলন্ত বাস বা যেকোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নারীরা চলাচলের সময় তার সঙ্গে ঘটা যেকোনও ইভ টিজিং বা যৌন নিপীড়নের জন্য তৎক্ষণাৎ সহায়তা চাইতে পারবেন, জরুরি সেবা নিতে পারবেন, ঘটনার রিপোর্ট করতে পারবেন।
পাইলট প্রকল্প হিসেবে এই সেবাটি ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে সায়েদাবাদ রুটে বাস্তবায়ন করা হবে। যদিও সীমিত আকারে সেবাটি দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে নারীরা নিতে পারবেন। মোহাম্মাদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত চলা বাসে কিউআর কোড স্থাপন ও এই অঞ্চলে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলাদা স্বেচ্ছাসেবক দলও তৈরি করা হবে, যেন নারীরা সরকারি সহায়তার পাশপাশি ইমার্জেন্সি ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে দ্রুত রেসপন্স পেতে পারেন এবং নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন।
জিপিএস ট্রেকিং এর মাধ্যমে নারীর প্রকৃত অবস্থান জেনে দ্রুতই যেন সহায়তা নিশ্চিত করা যায় সে ব্যাপারেও এই অ্যাপ্লিকেশন কার্যকর ভূমিকা রাখবে এবং স্বেচ্ছাসেবকদের এক্ষেত্রে ম্যানুয়ালি কাজ করারও অবস্থা থাকছে।
এই এপ্লিকেশন নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা রিপোর্ট করা এবং জরুরি সহায়তা পাওয়ার পথকে সহজ করবে। সরকারের ইমার্জেন্সি হেল্পলাইন ৯৯৯, নিকটবর্তী থানা, ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলকে কানেক্ট করবে হেল্প। ফলে ইমার্জেন্সি অবস্থায় নারীরা যেমন সহায়তা পাবেন তেমনি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তথ্য প্রমাণাদিসহ দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকছে এই অ্যাপ্লিকেশনে।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘হেল্প’ নামে অ্যাপটি চালু করা হয়েছে। এ অ্যাপটির মাধ্যমে নারীরা পুলিশের কাছে তাদের অভিযোগ জানাতে পারবেন।
‘ইয়ুথ প্ল্যানেট’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও হেল্প অ্যাপের মিডিয়া ক্যাম্পেইনার এ বি এম মাহমুদুল হাসান বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘আমরা সীমিত পরিসরে অ্যাপটির সেবা শুরু করলেও দ্রুত সময়ে মধ্যে যেন সেবাটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সে লক্ষে আমরা কাজ করছি। পাইলট প্রকল্প হিসেবে এই সেবাটি ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে সায়েদাবাদ রুটে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ রোডে কোনওনারী হয়রানির শিকার হলে সঙ্গেসঙ্গে আমাদের এই হেল্প অ্যাপের মাধ্যমে সহযোগিতা চাইতে পারবেন, অভিযোগ করতে পারেবন অভিযোগ পাওয়া মাত্র ওই এলাকার থানার পুলিশ সাড়া দেবেন। পাশাপাশি আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের এসময় সাহায্যে এগিয়ে আসবেন। শুধু মোহাম্মদপু টু সায়াদাবাদ রোড না পর্যায়ক্রমে দেশের যেকোনও প্রান্ত থেকে নারীরা এ হেল্প অ্যাপে হয়রানি শিকার হলে সহযোগিতা নেওয়ার সুযোগ থাকছে।’
অ্যাপে লিপিবদ্ধ হলে তৎক্ষণাৎ সেটি এফআইআর হিসেবে গণ্য হবে বলে ডিএমপির পক্ষে জানানো হয়েছে। যদিও এটি একটি নির্দিষ্ট তদন্তের পরই হওয়া উচিত বলে মনে করেন এ বি এম মাহমুদুল হাসান। তা নাহলে নিরপরাধ ব্যক্তিও ভুক্তভোগী হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ডিজিটাল প্লার্টফর্মের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা
ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ-বিরোধী যে আইনি কাঠামো প্রক্রিয়া, সেটি জটিল। আমরা বারবার বলে আসছি যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব বিচার নিশ্চিত করা হয়। যেখানে এখন সর্বোচ্চ ৯০ দিনের কথা বলা হচ্ছে, আমরা সেখানে ৬ মাসের কথা বলেছি যেন এসময়ে হলেও দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিচার দ্রুত নিশ্চিত করতে না পারলে এক্ষেত্রে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করাও কঠিন। এসব মামলা নিয়ে আর্থিক লেনদেনসহ নানারকম জটিলতায় পড়তে হয় ভুক্তভোগীকে।
পাশাপাশি ব্যাক্তি স্বার্থে উদ্ধারের জন্য অনেক সময় নির্দোষ ব্যক্তিকেও ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় বাদী বা বিবাদীর মিথ্যা আশ্রয় ও পুলিশ সদস্যদের ব্যাক্তিগত স্বার্থে তদন্তে পক্ষপাত হওয়া এসব কারণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেজন্য সবার আগে পুলিশকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।’
এ সংক্রান্ত কোনও মামলা লিপিবদ্ধ করার আগে প্রাথমিক যে তদন্ত সেটি নিখুঁতভাবে করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেখানে যেন কোনও অবিশ্বাস তৈরি না হয় সেটি খেয়লা রাখতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তা সরেজমিনে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে তারপর তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করতে হবে। তাহলে কোনও নির্দোষ ব্যক্তি যেমন ভুক্তভোগী হবেন না, তেমনি কোনও ভুক্তভোগীরও ন্যায়বিচার পেতে সহায়ক হবে।’