পটুয়াখালী জেলার বাউফলে গত বছরের শেষের দিকে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মামলা না নিতে চাওয়ার একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। ভুক্তভোগীর স্বজনদের বসিয়ে রেখে টালবাহানার অভিযোগ ওঠে বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। সে সময় স্বজনরা জানিয়েছিল, একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়েছে শিশুটিকে। পরে চিকিৎসা শেষে তারা থানায় মামলা করতে গেলে টালবাহানা শুরু করেন ওসি। বিভিন্ন অজুহাতে ভুক্তভোগীর স্বজনদের পাঁচ ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রাখেন তিনি। কিংবা তারও আগের বছরের আরেকটি ঘটনা— সাভারের আশুলিয়ায় বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে বিবাদীকে ডেকে টাকার বিনিময়ে মীমাংসা করান পুলিশের এক উপপরিদর্শক (এসআই)। এ অভিযোগে পরবর্তী সময়ে ওই কর্মকর্তাকে আশুলিয়া থানা থেকে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হলেও এ ধরনের আপস করে দেওয়ার ঘটনা অহরহই ঘটছে।
নারী অধিকারকর্মী যারা ভিকটিমদের সঙ্গে নানান সময়ে কাজ করেন, অভিজ্ঞতার বরাতে তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে এ ধরনের অনেক ঘটনার উদাহরণ পাওয়া যায়। যেখানে দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনার পর আইনি প্রতিকার পেতে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের যে হয়রানি এবং লড়াই শুরু হয় যে এরপর আর কেউ চাইবেন না এসবে জড়াতে। আবার যারা লড়াইটা করতে চান—তাদের অনেককে নতি স্বীকার করতে হয় আপসের চাপের কাছে। অধিকারকর্মীরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক থাকায় সবসময়ই মামলায় হস্তক্ষেপের একটা উদ্যোগ ধর্ষকের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়।
গত কয়েক দিন ধরে একের পর এক শিশু ধর্ষণের নির্মমতা দেখে— মাগুরার আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে সারা দেশ। শনিবার (৮ মার্চ) আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রাত থেকে দেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার দ্রুত বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন। এদিকে মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় রবিবার (৯ মার্চ) আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধকল্পে আমরা কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। এগুলো চূড়ান্ত করে শিগগিরই আইনগত পরিবর্তন আনা হবে। নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে না পারলে তাকে পরিবর্তন করে দেওয়া হতো। এভাবে চলতে থাকতো, এখন আর তা হবে না। ধর্ষণ মামলার তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে ১৫ দিনের মধ্যে, আর বিচার করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে। ধর্ষণ মামলা ৯০ দিনের মধ্যে শেষ না হলেও সেই অজুহাতে আসামির জামিন দেওয়া যাবে না।
২০২২ সালে ধর্ষণের শিকার এক ভুক্তভোগীর মা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘ধর্ষণের মামলা দায়ের করতে হলে, আর চালাতে হলে যে সহযোগিতা দরকার সেটা পাওয়া যায় না। সেজন্য মেয়েকে নিয়ে থানা থেকে মামলা না করেই বের হয়ে এসেছিলাম। আমাদের একটা সমাজ আছে। তারা (সমাজের জনগোষ্ঠী) যদি সায় না দেয়, তাহলে আমার একার এই বিচার চাওয়া সম্ভব না। আবার যদি আপনি মামলা করে ফেলেন, তাহলে সেই মামলা তুলে নেওয়া বা আপস-রফার জন্য হাজির হয় একাধিক পক্ষ। ধর্ষণের শিকার হয়ে যে কষ্টের শিকার হবেন, এসব সামাল দিতে গিয়ে সেই কষ্ট কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।’
‘মামলার পথটা এত দীর্ঘ, সেটা পাড়ি দিতে হিমশিম খেতে হয়’, উল্লেখ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সেদিক থেকে দেখলে আইনি কাঠামোর দুর্বলতা রয়েছে। আবার আমাদের যারা আইনজীবী তাদেরও মাঝেও কিছু বিষয় কাজ করে। তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষার ঘাটতি থাকে। তাদের আচরণেও নারীর প্রতি বৈষম্য, সামাজিকভাবে দায়িত্ববোধের অভাব দেখা যায়। ভিকটিমকে ন্যায়বিচার দিতে পারাটাও যে তার সাফল্যের একটা অংশ, সেটা মনে করে না বলে অন্য অনেক মামলার মতোই এটাকেও একটা সাধারণ মামলা হিসেবে দেখে।
বহু দিনের নারী আন্দোলনের পরে এখন এসে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই পুরো প্রক্রিয়ায় নারীর মধ্যে যে জাগরণ ঘটছে— সেটা অস্বীকার করা যাবে না। নানা অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ন্যায়বিচার ও মর্যাদার দাবি করতে শিখে গেছে এবং সেটা প্রয়োজন ছিল। এটাকে ভয় পায় যারা, তারা বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
পরিস্থিতি অস্বীকার না করে স্বীকার করে নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে উল্লেখ করে নারী অধিকারকর্মী খুশি কবীর বলেন, ‘ধর্ষণ হয়নি’, ‘মেয়েরা সিগারেট কেন খাবে’— এ ধরনের কথা বলে পাশ কাটিয়ে গেলে ঘটনা উসকে দেওয়া হয়। আমরা বলছি না যে সরকার সব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, আমরা চাই ঘটনা ঘটলে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। তা না করে উল্টো বক্তব্য দিলে ক্ষতি হয়। আরেকটা ইস্যুতে আতঙ্কিত বোধ করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের জামিন দেওয়ার কারণে খারাপ সিগন্যাল যাচ্ছে। যখন থেকে মব কালচার শুরু হলো, অথচ শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হলো না, তখনই এটা আরও বেশি প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আইন আছে, সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটি মনিটরিং করা জরুরি।