X
রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
৭ বৈশাখ ১৪৩২

আজ ভালোবাসার দিন, হৃদয়ের কথা বলার দিন

জুবায়ের আহমেদ
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:১৪আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:১৪

ভালোবাসা কখনও ক্যালেন্ডারের পাতায় বন্দি নয়, তবু ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি একদিন যেন অনুভূতিগুলো একটু বেশিই রঙিন হয়ে ওঠে। বসন্তের স্নিগ্ধতায় ভালোবাসা দিবস আসে সম্পর্কের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দিতে। এই দিনটি শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার নয়, বরং বন্ধুত্ব ও পরিবারের প্রতিও ভালোবাসা প্রকাশের বিশেষ সুযোগ। তবে সময়ের স্রোতে বদলেছে ভালোবাসার ভাষা, পাল্টেছে উদযাপনের ধরন। একসময় যা ছিল সংকোচের, আজ তা প্রকাশ্য। ভালোবাসা দিবস তাই শুধু উদযাপনের নয়, সম্পর্কের মূল্য বুঝে সংযম ও আন্তরিকতার সঙ্গে ভালোবাসার সত্যিকার অর্থ খুঁজে পাওয়ারও দিন। এ এক চিরন্তন আবেগের উৎসব।

একসময় ভালোবাসার প্রকাশ ছিল অসম্ভব

বাংলাদেশে ভালোবাসা প্রকাশের পথ একসময় সহজ ছিল না। সত্তর ও আশির দশকে প্রেম মানেই ছিল গোপনীয়তা। তখন প্রেমিক-প্রেমিকারা লুকিয়ে চিঠি আদান-প্রদান করতেন, রাতে ল্যান্ডফোনে কথা বলতেন, কিংবা দূর থেকে এক ঝলক দেখাই ছিল একমাত্র সুখ। প্রেম মানেই ছিল পারিবারিক ও সামাজিক কঠোরতার মুখোমুখি হওয়া।

নব্বইয়ের দশকে প্রেমের বিষয়টি কিছুটা উন্মুক্ত হলেও এখনকার মতো ভালোবাসা দিবস পালন ছিল কল্পনার বাইরে। তখন ভালোবাসার প্রকাশ ছিল অনেক সীমাবদ্ধ এবং পরিবার কিংবা সমাজ সহজভাবে নিতো না। শুধু প্রেম নয়, পরিবার পরিজনের প্রতিও আয়োজন করে ভালোবাসা প্রকাশের রীতি ছিল না।

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলেছে ভালোবাসা প্রকাশের ধরন

২০০০-এর দশকে মোবাইল ফোন, এসএমএস, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া জনপ্রিয় হওয়ার পর ভালোবাসার ধরন পাল্টে যেতে শুরু করে। এখন প্রেমিক-প্রেমিকারা সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন, মুহূর্তেই প্রকাশ করতে পারেন অনুভূতি। ফলে ভালোবাসা হয়েছে আরও উন্মুক্ত।

আগে যেখানে চিঠির জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হতো, এখন একটি কলের মাধ্যমে মুহূর্তেই প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলা যায়। শুরুতে যখন ব্যক্তিগত মোবাইলে কথা বলার সুযোগ হয়, তখন প্রেমিক-প্রেমিকারা রাত জেগে কথা বলতো। এখনও বিংশ শতাব্দীর তরুণরা রোমন্থন করেন সারা দিন অপেক্ষা শেষে মোবাইলে রিসার্জ করে রাতে কথা বলার স্মৃতি। এ যেন তাদের কাছে ভালোবাসার স্বর্ণযুগ। পরবর্তীতে সময়ের পরিক্রমায় এখন বাধাহীন ইন্টারনেটের যুগ। এখন সারাক্ষণ সবাই যুক্ত থাকে ইন্টারনেটে। শুধু কথা বলা নয়, চাইলে যখন তখন ভিডিওকলে ভালোবাসার মানুষটিকে দেখাও যায়।

ভালোবাসা দিবস উদযাপন: তখন ও এখন

কথিত আছে, ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে'র সূত্রপাত রোমান সাম্রাজ্যে। যেখানে খ্রিস্টান ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন প্রেমিকদের গোপনে বিয়ে করিয়ে দিতেন। এই কারণে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে তাকে স্মরণ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন শুরু হয়।

বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের সূচনা হয়েছিল একেবারেই নীরবে, গোপনে। ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে ভালোবাসা দিবস মূলত শহরের কিছু তরুণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন এটি ছিল লুকানো ভালোবাসার প্রকাশ। প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে চিঠি বিনিময়, হাতে লেখা কার্ড, কিংবা ল্যান্ডফোনের মাধ্যমে দূরবর্তী যোগাযোগ।

বর্তমানে ভালোবাসা দিবসের উদযাপন ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। ২০০০ সালের পর, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল প্রযুক্তির উত্থানের ফলে ভালোবাসা দিবস এখন শুধু শহরাঞ্চলেই নয়, বরং গ্রামাঞ্চলেও পালিত হয়। আজকাল ভালোবাসা প্রকাশের উপায়গুলো অনেক সহজ ও সাশ্রয়ী হয়ে গেছে। এখন প্রিয়জনদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য অতিরিক্ত সময় ও প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না।

বর্তমান সময়ে ফুল, চকলেট, গিফট আইটেম—এসব উপহারের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করা হয়। সেলফি ও সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে ভালোবাসার অনুভূতি প্রকাশ করা এখন ট্রেন্ড। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ভালোবাসার বার্তা সহজে পাঠানো সম্ভব। ভিডিওকলের মাধ্যমে দূরবর্তী সম্পর্কগুলোও একেবারে কাছের হয়ে যায়।

এছাড়া এ দিন শহরজুড়ে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, পার্ক, ক্যাফে, শপিংমল, সিনেমা হলে তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি বাড়ে। একে অপরকে বিশেষ উপহার দেয়, একসঙ্গে সময় কাটায়।

বর্তমানে এই দিনটি শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বন্ধু, পরিবারের সদস্য, এমনকি কর্মক্ষেত্রেও ভালোবাসার প্রকাশ দেখা যায়। অনেকেই বাবা-মা, ভাই-বোন, শিক্ষক বা কাছের মানুষদের ফুল, চকলেট, কিংবা উপহার দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করেন। তাই তরুণ প্রজন্মের জন্য এই দিনটি এখন অনুভূতি প্রকাশের এক অবিস্মরণীয় দিন হয়ে উঠেছে।

সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিবন্ধকতা

ভালোবাসা দিবস নিয়ে বাংলাদেশে এখনও নানা বিতর্ক রয়েছে। কিছু অংশ একে ‘পাশ্চাত্য সংস্কৃতি’ হিসেবে দেখে, কেউ কেউ মনে করেন এটি তরুণদের নষ্ট করে দিচ্ছে। প্রতিবছর কিছু জায়গায় ভালোবাসা দিবসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানানো হয়।

তবে বাস্তবতা হলো, ভালোবাসা দিবস এখন সমাজের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। তরুণ প্রজন্ম এটি উদযাপন করলেও, অনেক মধ্যবয়সী বা প্রবীণও এই সংস্কৃতিকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছেন।

ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ

ভালোবাসা শুধু একদিনের ব্যাপার নয়, এটি সারা বছরের অনুভূতি। ভালোবাসা মানে শুধু একটি সম্পর্কের স্বীকৃতি নয়, বরং পরস্পরের প্রতি সম্মান, যত্ন ও বিশ্বাস। এমনটাই মনে করেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। তারা বলেন, সব বাধা পেরিয়ে ভালোবাসা দিবস এখন ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে ভালোবাসার ধরন আরও বদলাবে, কিন্তু ভালোবাসার গুরুত্ব কখনও কমবে না। তবে প্রযুক্তির সহজলভ্যতার মাঝে অনুভূতির গভীরতা যেন হারিয়ে না যায় সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। সম্পর্ক শুধু উপহার, ছবি বা স্ট্যাটাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, আবেগ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার জায়গা তৈরি করতে হবে।

এ বিষয়ে বইমেলায় আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মির্জা সানি বলেন, ‘ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোনও অর্থ আমার জানা নাই। তবে আমি মনে করি ভালোলাগাই ভালোবাসা। কারও প্রতি ভালোলাগা না থাকলে তাকে ভালোবাসা যায় না।‘

বইমেলায় আসা আরেক শিক্ষার্থী স্নিগ্ধা রায় বলেন, ‘ভালোবাসা মানে তারুণ্য। মানুষের বয়স বাড়ে কিন্তু ভালোবাসা তরুণই রয়ে যায়। তাই মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে। সে নিজেকে চির তরুণ মনে করতে থাকে, বয়স যাই হোক না কেন।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী নাঈম ইসলাম সোহাগ বলেন, ‘ভালোবাসাকে দু-এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তবে অল্প কথায় বলতে গেলে, ভালোবাসা মানে- যত্ন, দায়িত্ব, অধিকারের ব্যক্ত কিংবা অব্যক্ত অনুভূতিকে বোঝায়, যা প্রবহমান থাকে হৃদয় কোণে, নিঃশব্দে, নিবৃত্তে, নিরবধি।'

পল্লবীর বাসিন্দা মিতালী আক্তার বলেন, ‘ভালোবাসা অর্থ সুন্দর সম্পর্ক। এই ভালোবাসা বলতে যে কেবল শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা বোঝায় সেই চিন্তা থেকে বেরিয়ে এটি পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী—সবার প্রতিই থাকা উচিত। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, ভাই-বোনের মধ্যকার স্নেহ, কিংবা বন্ধুদের প্রতি নির্ভরতার সম্পর্ক—সবই ভালোবাসার বিভিন্ন রূপ। একদিনের জন্য নয়, সারা জীবন ধরে এ ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন।'

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী সাদ্দাফ হাসান বলেন, 'ভালোবাসতে দিবসের প্রয়োজন হয় না ঠিকই, কিন্তু সবাই চায় প্রিয় মানুষের একটি দিন বিশেষ করে তুলতে, আর ভালোবাসা দিবস সেই প্রত্যাশার আনুষ্ঠানিক একটা রূপ দেয়। তাই ভালোবাসা দিবসটি মানুষের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ।’

/আরআইজে/
সম্পর্কিত
বিয়ের কথা বলে ফেনীতে এনে বিদেশি নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ, গ্রেফতার ১
ছবিতে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসা দিবস উদযাপন!
ভালোবাসা দিবসে ফুল বিক্রি করায় দোকান ভাঙচুর, বসন্তবরণ অনুষ্ঠান স্থগিত
সর্বশেষ খবর
ক্রুর যাত্রা থামিয়ে অপরাজিত মেসির ইন্টার মায়ামি
ক্রুর যাত্রা থামিয়ে অপরাজিত মেসির ইন্টার মায়ামি
বরগুনা জেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক গ্রেফতার
বরগুনা জেলা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক গ্রেফতার
টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ
টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আবারও ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ
যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আবারও ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
কপি-পেস্টে চলছে ১৩ পত্রিকা, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
কপি-পেস্টে চলছে ১৩ পত্রিকা, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
গাজীপুরে সেই দুই শিশুকে হত্যা করেছেন মা: পুলিশ
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
আ.লীগের ঝটিকা মিছিল, বিপাকে পুলিশ
হিন্দু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় হত্যা: নিন্দা জানালো ভারত
হিন্দু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় হত্যা: নিন্দা জানালো ভারত