‘আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা/ কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে।’ শীতের শেষে প্রকৃতি সাজে আপন মহিমায়। পলাশ, শিমুলসহ বর্ণিল ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে চারপাশ। সেই রঙের পরশ ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে। প্রকৃতি জানান দেয় বসন্ত আগমনের। আজ পহেলা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। প্রকৃতির দক্ষিণা দুয়ারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। কোকিলের কণ্ঠে আজ বসন্তের আগমনী গানে মুখরিত হয়েছে প্রকৃতি। ফুলে ফুলে ভ্রমরও করছে খেলা, গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। সব কিছুই জানান দিচ্ছে ফাল্গুন এসেছে এ ধরায়।
শুকনো পাতা ঝরে জন্ম নিয়েছে নতুন কচি পাতার। আজ সেই পত্র-পল্লবে, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর পাহাড়ে অরণ্যে বসন্ত এসেছে নবযৌবনের ডাক দিয়েছে। ছড়িয়ে দিয়েছে রঙের খেলা। সব ধরনের কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, নতুন প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে বসন্তের আগমন। তাই কবির ভাষায়—‘ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত’।
বসন্ত বাঙালির জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। বসন্তের বন্দনা আছে কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায়। বহু বছর ধরেই বসন্তের প্রথম দিনকে বাঙালিরা ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসেবে পালন করে আসছে। এ উৎসব এখন সবার। এ উৎসবটির একটি ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে।
মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম বসন্ত উৎসব। তখন অবশ্য ঋতুর নাম ও উৎসবের ধরনটা এখনকার মতো ছিল না। তাই বসন্ত উৎসব শুধু একটা উৎসব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য।
বসন্ত উন্মাদনায় আজ মেতে উঠবে তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষ। বসন্তের বন্দনা ছড়াতে হলুদ, বাসন্তী রঙের শাড়ি, নজরকাড়া পাঞ্জাবি পরে এবং রঙিন ফুলে নিজেদের সাজিয়ে শীতকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়েই চলবে ধুমধাম আয়োজন। শীত চলে যাবে রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসবে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরা-জীর্ণতা। ভালোবাসার মানুষেরা মন রাঙাবে বাসন্তী রঙেই। পিঠা উৎসবও হবে নতুন আঙ্গিকে।
বসন্ত যেমন আমাদের খুশির ঋতু, তেমনি বেদনারও বটে। ফাগুনে শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ মনে করিয়ে দেয় বায়ান্নর ফাগুনের শহীদদের কথা। ফাল্গুন মনে করিয়ে দেয় ভাষা শহীদদের রক্তের ইতিহাস। যা লুকিয়ে থাকা বসন্তের দূত কোকিলের মতো ব্যাকুল করে তুলবে বাঙালির বিরহী অন্তর।
এদিকে, দিনটিকে আরও উপভোগ্য করে তুলতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন গ্রহণ করেছে নানা কর্মসূচি। প্রতি বছরের মতো এবারও বসন্ত উৎসব পালন করবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। দেশবরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে সংগীত, কবির কণ্ঠে কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, নৃত্য, বসন্তের পোশাক প্রদর্শনী ও কোরিওগ্রাফির নান্দনিক আয়োজনে মেতে উঠবে সবাই।
শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকেই বসন্তকে বরণ করে নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুল তলায় জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ ‘বসন্ত উৎসব-১৪৩১’ আয়োজন করেছে। প্রতিবছরের মতো এবারও সকাল থেকেই শোভাযাত্রা, গান-বাজনাসহ নানা আয়োজনে দিনব্যাপী চলবে এই অনুষ্ঠান।
বসন্তের আগমনে সেজেছে শাহবাগের ফুলের দোকান
ভালোবাসাকে রাঙিয়ে তুলতে এবং বসন্তকে বরণ করে নিতে ফুলে ফুলে সেজেছে শাহবাগের ফুল দোকানগুলো। দর্শক ক্রেতাদের ভিড়ে শাহবাগ এখন রাজধানীর সুন্দর পর্যটন স্পট।
বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় শাহবাগের ফুলের দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, গোলাপ, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা, গাদা ফুলের গন্ধে সুবাসিত চারপাশ। আরও নানা রকম দৃষ্টিনন্দন ফুল। ফুলের গন্ধে মৌমাছির মতো ছুটে আসছে বসন্তপ্রেমীরা। তরুণ-তরুণীদের কেউ বা ফুল কিনছে কেউবা ছবি তুলছে। ফুল কিনে প্রিয়জনের কানে গুঁজে দিতেও দেখা যায় অনেকের।
তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, এবারও ফুলের দাম বেশি। ব্যবসায়ীদের সরল স্বীকারোক্তি ‘সারাবছর কোনও ব্যবসা থাকে না, এই দুদিনই একটু ব্যবসা হয়। দাম খুব বেশি বাড়ানো হয় না।’
এবারের ফুলের দাম সম্পর্কে ব্যবসায়ীরা জানান, দেশি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৫৫ টাকায়, চায়না গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬৫ টাকায়। এছাড়াও অন্যান্য ফুলের দামও অল্প পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে।
বাবার ফুল দোকানে ফুল বিক্রিতে সাহায্য করতে এসেছেন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী স্বচ্ছ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই দুদিন দোকানে একটু চাপ পড়ে। বাবা একা সামলাতে পারেন না। তাই এলাম একটু হেল্প করতে। বিক্রি খুব ভালো নয়। প্রায় ২ লাখ টাকার ফুল আনা হয়েছে। আজ অর্ধেক বিক্রি না হলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। ক্রেতারা আসছেন ভালোই, তবে দাম শুনে ফুল কিনছেন না। বেশির ভাগই ছবি তুলে চলে যাচ্ছেন। এতে ফুলও নষ্ট হচ্ছে। তবে আশা করছি কাল ফুলগুলো বিক্রি হয়ে যাবে।
দাম বৃদ্ধির কারণ জানিয়ে বিক্রেতা নাসিরউদ্দীন বলেন, এই ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে আমাদেরও বেশি দাম দিয়ে ফুল কিনতে হয়েছে। ফুলের দাম প্রতিবছরই এ সময় একটু বেশি থাকে। বিক্রি হচ্ছে কম-বেশি। ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ফুল এনেছি। শেষ হয়ে যাবে আশা করছি।
প্রিয়জনকে নিয়ে হাজারীবাগ থেকে ঘুরতে এসেছেন ইসরাত মেহেজাবীন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা বইমেলায় ঘুরতে এসেছিলাম। এখন শাহবাগে ফুল কিনতে এসেছি। বাসায় আম্মুর জন্য অনেক ফুল কিনেছি।
আগামীকাল ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে তিনি বলেন, আজ প্রিয়জনের সঙ্গে ঘুরতে এসেছি, কাল বাবা-মাকে সময় দেবো। তাদের সঙ্গে ঘুরতে যাবো।
ফুলের রিং কিনে সহধর্মিণীর মাথায় পরিয়ে দিলেন জাহিদ হাসান। বলেন, বসন্তের আগমন সবসময়ই খুব সুন্দর হয়। আমরা এসেছি ঘুরতে। শাহবাগে অনেকবার আসা হয়েছে, তবে সহধর্মিণীকে নিয়ে এবারই প্রথম। অনেক ভালো লাগছে। আজ সন্ধ্যার শাহবাগ বসন্তেরই আরেক রূপ।
ফুলের দাম সম্পর্কে তিনি বলেন, একটু বেশি। ফুলের এই রিংয়ের দাম ১৫০ টাকা। সারা বছর এটি ৫০ বা ৬০ টাকায় পাওয়া যায়।