বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বিচারক (বিচারপতি) নিয়োগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। মূলত বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতেই এই দাবি ছিল সর্বত্র। সে দাবি পূরণের লক্ষ্য নিয়ে ‘সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে অধ্যাদেশ জারির পর এটি নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বিচার বিভাগ সংস্কারে গুরুত্ব দেয় সরকার ও নতুন দায়িত্ব পাওয়া প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। যার ধারাবাহিকতায় একই বছরের ২৮ নভেম্বর এ অধ্যাদেশটির একটা খসড়া সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল।
এরপর গত ২১ জানুয়ারি ‘সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত সদস্যের এই কাউন্সিল যাচাই-বাছাই করে বিচারক নিয়োগের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। তবে রাষ্ট্রপতি চাইলে কারণ উল্লেখ করে কাউন্সিলের সেই সুপারিশ থেকে কারও নাম ফেরত পাঠাতে পারবেন।
অধ্যাদেশের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ প্রদান প্রক্রিয়ায় প্রধান বিচারপতিকে সহায়তা করতে এই অধ্যাদেশ অনুসারে উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাই করে সুপারিশের জন্য একটি স্থায়ী কাউন্সিল থাকবে, যার নাম হবে ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’।
অধ্যাদেশের ৩ ধারায় আরও বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি হবেন সাত সদস্যের এই কাউন্সিলের চেয়ারপারসন। কাউন্সিলের সদস্যরা হলেন— আপিল বিভাগে কর্মে প্রবীণতম বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগে কর্মে প্রবীণতম বিচারক, বিচার-কর্ম বিভাগ (অধস্তন আদালত) থেকে নিযুক্ত হাইকোর্ট বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারক, চেয়ারপারসনের মনোনীত আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল (পদাধিকারবলে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান) এবং চেয়ারপারসনের মনোনীত একজন আইনের অধ্যাপক বা আইন বিশেষজ্ঞ।
আর ৪ ধারা মোতাবেক, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল এই কাউন্সিলের সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
অধ্যাদেশটির চারটি ধারা সংশোধনের পদক্ষেপ চেয়ে ইতোমধ্যে সরকার সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন আইনজীবী আজমল হোসেন।
নোটিশ পাঠানোর বিষয়ে আইনজীবী আজমল হোসেন বলেন, ‘অধ্যাদেশ অনুসারে বিচারক বাছাইপূর্বক সুপারিশের জন্য একটি কাউন্সিল থাকবে— যেখানে প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগ থেকে দুই ভাগে দু’জন বিচারক থাকবেন। আর রেজিস্ট্রার জেনারেলকে করা হয়েছে সদস্য সচিব। সেখানে স্বার্থের সংঘাত রয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। এছাড়া বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ বছর। এতে অনেক যোগ্য লোক বঞ্চিত হবেন। তাই তিন দিনের মধ্যে অধ্যাদেশটি সংশোধন চেয়ে আইনি নোটিশ প্রেরণ করেছি। এ বিষয়ে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হবো।’
এদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশটিকে বৈষম্যমূলক বলে দাবি করেছেন।
ব্যারিস্টার খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের জারি করা অধ্যাদেশটি দেখেছি। অধ্যাদেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত সদস্যের এই কাউন্সিল যাচাই-বাছাই করে বিচারক নিয়োগের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু কোনও আইনজীবী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। অথচ অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। কোনও আইনজীবী প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তাই এই অধ্যাদেশ আইনজীবী সমাজকে হতাশ করেছে। এটা বৈষম্যমূলক। আমি এই অধ্যাদেশ সংশোধনের দাবি জানাচ্ছি।’