গত বছরের তুলনায় এই বছর অভিবাসনের হার ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ কম হতে পারে বলে ধারণা করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। একইসঙ্গে নারী কর্মীর বিদেশ যাওয়ার হার সর্বনিম্ন রেকর্ডের পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন তারা।
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাংলাদেশ হতে শ্রম অভিবাসনের গতি- প্রকৃতি ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন রামরু’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখ ৬ হাজার ৩৫৫ জন পুরুষ এবং নারী কর্মের উদ্দেশ্যে বিদেশ গেছেন। ২০২৩ সালে অভিবাসী পুরুষ ও নারীর সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে যে গতিতে অভিবাসন ঘটেছে, তা অব্যাহত থাকলে বছরের শেষে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশে যেতে পারেন। অর্থাৎ, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে (নভেম্বর পর্যন্ত) অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ কম হতে পারে।
তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, গণঅভ্যুত্থানের কারণে জুলাই এবং আগস্ট মাসে অভিবাসনের গতি ব্যাহত হয়েছিল, যার প্রভাব সার্বিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণের দীর্ঘসূত্রিতা কমানো। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তৎপর হওয়ায় অক্টোবর এবং নভেম্বরে প্রতি মাসে লাখেরও বেশি কর্মী বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বিদেশে গেছেন।
এ সময় বিদেশ থেকে ফেরত আসা কর্মীর তথ্য সংগ্রহ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কত বাংলাদেশি কর্মী অভিবাসিত হয়েছেন সে হিসেব থাকলেও প্রতিবছরে কর্মচুক্তি সম্পাদন করে কত জন দেশে ফিরেছেন তার তথ্য সংগ্রহ আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তিত কর্মীর ডাটা সংগ্রহ পদ্ধতি বিনির্মাণের এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।
নারী অভিবাসন কমে যাওয়া প্রসঙ্গে প্রতিবেদন বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৬৯৬ জন নারী কর্মী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন। অর্থাৎ এই সময়ের মোট অভিবাসীর ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ ছিলেন নারী কর্মী। কোভিডকালীন সময় বাদ দিলে গত ১০ বছরে এটি নারী অভিবাসনের সর্বনিম্ন রেকর্ড। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে নভেম্বর পর্যন্ত নারীর অংশগ্রহণ ২২ শতাংশ কমেছে। রামরু’র এক গবেষণা মতে, শোভন কর্মক্ষেত্রের অনিশ্চয়তার কারণে নারী কর্মীরা ক্রমশই অভিবাসনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
শ্রমবাজার কমে আসা প্রসঙ্গে বলা হয়, বিভিন্ন সরকার ইতোপূর্বে ঢালাওভাবে প্রচার করে আসছে যে, বাংলাদেশি নারী এবং পুরুষ কর্মীরা বিশ্বের ১৬৮টি দেশে কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে প্রতিবছর সিংহভাগ অভিবাসী উপসাগরীয়, অন্যান্য আরব, পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ১২ থেকে ১৩টি দেশেই অভিবাসিত হয়ে থাকেন। গত পাঁচ বছরে ৯৭ ভাগ কর্মী গেছেন মাত্র ১০টি দেশে। এই বছরে ৯০ ভাগ বাংলাদেশি কর্মী অভিবাসিত হয়েছেন মাত্র ৬টি দেশে। এ বছরে সৌদি আরবেই গেছেন ৬০ ভাগ কর্মী, মালয়েশিয়া গেছেন ১০ দশমিক ৩০ ভাগ কর্মী, কাতারে ৭ দশমিক ৫৬ ভাগ, সিঙ্গাপুরে ৫ দশমিক ৭৬ ভাগ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫ দশমিক ২০ ভাগ এবং জর্ডানে গেছেন ১ দশমিক ৫৪ ভাগ।
তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ২০২৪ সালে বেশ কিছু দেশে কর্মী যাওয়া বন্ধ রয়েছে। ওমান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালদ্বীপসহ বেশ কয়েকটি দেশে এ বছর কোনও অভিবাসন হয়নি। ইতালিতে জাল কাগজপত্রের কারণে এবং সার্বিয়ার আবেদন প্রক্রিয়ার সার্ভার অকেজো হওয়ায় শ্রম অভিবাসন কার্যক্রম থেমে আছে। অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্রে বাংলাদেশের এক গন্তব্যকেন্দ্রিক বাজার ব্যবস্থাকে বিভিন্ন বাজার বন্ধের একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, কোনও নতুন বাজার খুললে সেখানে বাংলাদেশের এবং গন্তব্য দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ব্যাপক হারে কর্মী পাঠানো শুরু করে। তবে, সেসব দেশে অবস্থানরত লেবার উইং যদি নিয়োগকর্তার সক্ষমতা বা ব্যাকগ্রাউন্ড যথাযথভাবে যাচাই না করে ছাড়পত্র দেয়, তাহলে তা পরবর্তীতে অব্যবস্থার সৃষ্টি করে এবং নিষেধাজ্ঞার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিবছর বিশ্বের রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ৭ম অথবা ৮ম অবস্থানে থাকে। কিছু কিছু বছর বাদ দিলে প্রতি বছরেই রেমিট্যান্স প্রায় ১০ এবং ততোধিক হারে বেড়েছে। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতিতে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। ২০২১ সালে রেমিট্যান্স পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় মাত্র ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ২০২২ সালে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় রেমিট্যান্স কমে যায় ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ধরে নেওয়া হয় অভিবাসীরা বিদেশে যাওয়ার পরপরই রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে না, সেক্ষেত্রে ৬ মাস যদি ল্যাগ পিরিয়ড ধরা হয় তারপরও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক।
তিনি বলেন, এ বছরের প্রথম সাত মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার। আগস্ট থেকে নভেম্বরে পর্যন্ত ৯ দশমিক ২২৩ বিলিয়ন ডলার। গত ১১ মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সালে মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৩২ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি হবার সম্ভাবনা। কিন্তু দেখা গেছে যেসব দেশে অভিবাসন বেশি হয়েছে সেসব দেশ হতে রেমিট্যান্স বাড়েনি। এ বছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় প্রতিভাত হচ্ছে। রেমিট্যান্স পাঠানো দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অবস্থান গতানুগতিক ব্যাখ্যার বাইরে।
অনুষ্ঠানে রামরুর প্রোগ্রাম পরিচালক মেরিনা সুলতানাসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।