সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দুর্নীতি ও আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করার অভিযোগ ওঠে কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে হাইকোর্টের ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো নিয়ে দিনভর সরগরম ছিল কোর্ট প্রাঙ্গণ। দাবি-বিক্ষোভ এবং কয়েক দফা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয় কোর্ট কর্তৃপক্ষ।
বিচার বিভাগীয় কয়েকটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, চায়ের নিমন্ত্রণের জন্য ১৫ অক্টোবর ১২ বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এর ধারাবাহিকতায় একই দিন কয়েকজন বিচারপতি আমন্ত্রণে এসে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে যান।
এদিকে, গত মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম দুই সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ্ ও সারজিস আলম ১৬ অক্টোবর দুপুর ১১টার সময় সুপ্রিম কোর্টে বিক্ষোভের ডাক দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজ বুধবার (১৬ অক্টোবর) সকাল ১১টা ৩০ মিনিটের সময় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে (অ্যানেক্স ভবনের সামনে) হাজির হতে থাকেন ছাত্ররা। গলায় ঝুলানো আইডি কার্ড থেকে বোঝা যায়, তাদের অধিকাংশ ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এসময় বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরাও পৃথক ব্যানারে বিচারপতিদের অপসারণ চেয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। নির্ধারিত সময় ১১টার দিকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় কম সংখ্যক শিক্ষার্থী জড়ো হয়েছিল। তাই দুপুর ১২টা ২৪ মিনিটের সময় কয়েকশ’ শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে হাসনাত-সারজিসরা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে হাজির হন।
বিক্ষোভের একপর্যায়ে বিচারপতিদের অপসারণ করাসহ ৩ দফা আল্টিমেটাম দেয় হাসনাত আবদুল্লাহ। দাবিতে বলা হয়, দুপুর দুইটার মধ্যে ফ্যাসিস্ট বিচারপতিদের অপসারণ করতে হবে, আওয়ামী লীগের আইনজীবীদের অপসারণ করতে হবে এবং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। দুপুরের মধ্যে দাবি বাস্তবায়ন না হলে হাইকোর্ট ঘেরাও থাকবে জানান হাসনাত।
আল্টিমেটাম চলা অবস্থায় দুপুর ২টা ১০ মিনিটের দিকে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, হাইকোর্টের ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। এ বিষয়ে প্রায় সব গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জানানোর পূর্বেই এ ধরনের সংবাদ প্রচার/প্রকাশের কারণে প্রধান বিচারপতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন বলেও সুপ্রিম কোর্টের এক কর্মকর্তা জানান।
এসময় একে একে হাইকোর্টের ছয় জন বিচারপতি মো. দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নুর উদ্দিন, বিচারপতি মাসুদ হোসেন দোলন, বিচারপতি আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামান প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। তবে এসব বিচারপতি তাদের আগমনের কারণ সম্পর্কে গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনও কথা বলতে চাননি। এসময় হাইকোর্টের আরও দুজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে অভিযোগ ওঠা বিচারপতিদের তালিকায় তাদের নাম নেই।
দুপুর ১টা ৫ মিনিটের সময় হাসনাত আবদুল্লাহ কয়েকজন সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থীকে সঙ্গে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে প্রবেশ করেন। কিন্তু আদালত ভবনের গার্ডেনে প্রবেশে আপত্তি জানালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহ মো. বাবরের সঙ্গে হাসনাতের বাগবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়। পরে হাসনাতসহ কয়েকজন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কক্ষে প্রবেশ করেন।
এরপর হাসনাতসহ কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে কয়েক দফা রুদ্ধদ্বার আলোচনা করেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞাঁ।
আলোচনা শেষে সমন্বয়ক হাসনাতসহ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল অ্যানেক্স ভবনের সামনে আসেন। এসময় আজিজ আহমদ ভূঞাঁ বলেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, অভিযোগ ওঠা ১২ বিচারপতিকে কোনও বিচারিক বেঞ্চ দেওয়া হবে না। বেঞ্চ দেওয়া হবে না মানে কী তা আপনারা নিশ্চয় বুঝে গিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, আগামী রবিবার আদালত খুললে বিচারকদের অপসারণ সংক্রান্ত মামলা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে তোলা হবে। ইতোমধ্যে ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি প্রতিনিধিদল আমার সঙ্গে দেখা করেছে। তাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় আমরা আলোচনা করেছি। পরবর্তীতে এই বিষয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি। বিচারপতিদের পদত্যাগ কিংবা অপসারণের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই সংক্রান্ত কোনও আইন নেই। বিগত সরকার বিচারপতিদের অপসারণে একটি অ্যামেন্ডমেন্ট নিয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেটি বাতিল করে দিয়েছে। এটি আবারও রিভিউর জন্য সরকার আবেদন করেছে। আগামী ২০ অক্টোবর রবিবার আদালত খুলবে। এটা নিয়ে ২০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দেবেন।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের বক্তব্যের পরও বিক্ষোভকারীরা আজই অভিযোগ ওঠা সব বিচারপতির অপসারণ চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। তখন হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায় আশা করি রবিবার আসবে। বিচারপতিদের অপসারণে সেদিনই পদত্যাগ করতে হবে। রায়ের জন্য রবিবার বিকাল পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করবো। হাইকোর্ট, জজকোর্টসহ দেশের বিচারালয়ে দম্ভের সঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল করেছে, যাদের হাতে দুই হাজার শহীদের রক্তের দাগ রয়েছে, তারা খুনি হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে চায়। তাদের অপসারণে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা নেই। তাই আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখে এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাই। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের গ্রেফতার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের ফ্যাসিস্ট ১২ বিচারপতিকে অপসারণের দাবিতে রবিবার পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। রবিবার তাদের অপসারণ করা না হলে আমরা আরও কঠোর আন্দোলনের দিকে যাবো। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেছি। আমাদের আন্দোলনের প্রতিফলনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। আমরা এ দেশে আর কোনও ফ্যাসিস্ট সরকার দেখতে চাই না এবং ফ্যাসিবাদীদের কোনও ঠাঁই দেওয়া হবে না।
সূত্রগুলো জানায়, আজ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে চায়ের নিমন্ত্রণে হাজির না হলেও ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে আরও ছয় বিচারপতিকে। তারা হলেন- বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি মো. খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি খিজির হায়াত ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান। তবে এই তালিকা দীর্ঘ হতে পারে বলেও সূত্র জানায়।
আরও পড়ুন: