একাকীত্ব, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, চাকরি হারানো, ঠিকমতো বেতন না পাওয়াসহ সুনির্দিষ্ট কিছু কারণে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীরা মানসিকভাবে নানা সংকটের সম্মুখীন হন। দেশে ফেরার পরে অনেকের এই সংকট ভিন্ন মাত্রা পায়। বিশেষ করে যারা ব্যর্থ হয়ে বা অনেকদিন পর দেশে ফেরেন, তাদের এই সংকট বেশি। পুরুষের চেয়ে নারীদের সংকট আবার জটিল। সংকট সমাধানে অভিবাসী কর্মী ও বিদেশ-ফেরতদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ কাউন্সেলিং পেলে তারা দ্রুত স্বাভাবিক হতে পারেন। কিন্তু দেশে কাউন্সেলিং ও মনোচিকিৎসক সংকটের কারণে সেই সেবা পর্যাপ্ত মেলে না। কাজেই অভিবাসন অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
অভিবাসী ও বিদেশ-ফেরত অভিবাসীদের মনোসামাজিক সংকট নিয়ে করা ব্র্যাকের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এই গবেষণা পরিচালিত হয়।
বুধবার (৯ অক্টোবর) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ গবেষণার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। সুইজারল্যান্ডের সহায়তায় ‘রিইন্টিগ্রেশন অব মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় গবেষণাটি করা হয়েছে।
গবেষণার তথ্য বলছে, বিদেশ-ফেরতদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে সাদৃশ্যপূর্ণ লক্ষ্মণগুলো পাওয়া গেছে তা হলো— বিরক্তি, অসহায়ত্ব, ট্রমা, আত্মঘাতী আচরণ, ঘুমের সমস্যা, রাগ, বিধ্বস্ত অনুভূতি, মন খারাপ, মনের মধ্যে ফাঁকা অনুভূতি হওয়া, মানসিক চাপ, হতাশা, উদ্বেগ, অপরাধবোধ, আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা, নেতিবাচক মন্তব্যের ভয় এবং মানুষের প্রতি অবিশ্বাস।
গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, মনোসামাজিক সহায়তা পাওয়ার পরে বিদেশ-ফেরতরা নিজেদের মানসিক স্থিতি রক্ষা করতে নিজস্ব কৌশল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে আত্মপ্রেরণার মাধ্যমে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া, নেতিবাচক মন্তব্য উপেক্ষা করা, জীবনসঙ্গীর ওপর নির্ভর করা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা, দৈনন্দিন কাজে সক্রিয় থাকা, পরিবারের মন্তব্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া, প্রতিবন্ধকতাগুলো মেনে নেওয়া এবং কষ্টদায়ক স্মৃতিগুলো পুনরায় মনে না করা।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে কাউন্সেলিং সেবা প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বা সুবিধা অনুপস্থিত অথবা অপর্যাপ্ত। এছাড়া, দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর অভাব এবং বিশেষত বিদেশ-ফেরত বা অভিবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পর্যাপ্ত গবেষণা না থাকার কারণে পিএসএস কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমরা বিদেশ-ফেরতদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি একাকীত্ব, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন, চাকরি হারানো, ঠিকমতো বেতন না পাওয়াসহ সুনির্দিষ্ট কতোগুলো কারণে অভিবাসীরা মানসিক সংকটে পড়েন। কিন্তু বাংলাদেশের অন্য সবার মতো প্রবাসীরাও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেন না। তবে আমরা দেখেছি— যারা কাউন্সেলিং সেবা নিয়েছেন বা পেয়েছেন, তারা দ্রুত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। বিশেষত নারীরা পুরুষদের চেয়েও দ্রুত সুস্থ হয়েছেন।
কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, অভিবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা বিষয়ক অ্যাডভোকেসি গন্তব্য দেশ থেকেই শুরু করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের পুনরেকত্রীকরণ নীতিতে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিক এবং পাচার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য মনোসামাজিক সহায়তা সেবা (পিএসএস)-কে অন্তর্ভুক্ত করার ওপরেও আমাদের জোর দিতে হবে।
অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য তৈরি মানসিক স্বাস্থ্য মডেলগুলো ব্র্যাকের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিভাগ এবং অংশীদারদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান প্রধান গবেষক।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল মান্নান বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটা অনেক সময় আমরা বুঝে উঠতে পারি না। সরকার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিদেশ-ফেরতদের জন্য পুনরেকত্রীকরণ
নীতির খসড়ায় বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা কাজ করবো।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের রেইজ প্রকল্পের পরিচালক ড. এ.টি.এম. মাহবুব-উল করিম বলেন, বিদেশ-ফেরতদের দৃশ্যমান সহায়তা করা আমাদের লক্ষ্য। বিদেশ থেকে ফেরত আসার পর আমরা যেমন তাদের কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছি তেমনি বিদেশগামী কর্মীদেরকে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি জানাতে হবে।
অনুষ্ঠানে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন ওমান ও সৌদি আরব ফেরত দুইজন প্রবাসী। গন্তব্য দেশে প্রতারণা ও নির্যাতনের কারণে তাদের যে নানা মানসিক সংকটে ভুগতে হয়েছে সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এক নারী বলেন, আমাদের কথা তো কেউ শোনে না। ব্র্যাকের কাউন্সেলররাই প্রথম আমাদের কথা সময় নিয়ে শুনেছেন। তারা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন কীভাবে সুস্থ থাকতে হবে। তাদের কাছ থেকে মনোসামাজিক সহায়তা পেয়ে আমরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, সারাদেশে যে পরিমাণ কাউন্সেলর ও মনোচিকিৎসক দরকার সেটা কীভাবে পূরণ করা যায় তা আমাদের দেখতে হবে।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া সুইস এজেন্সি ফর ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজিয়া হায়দার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাহনুমা সালাম খান, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) প্রকল্প ব্যবস্থাপক আসমা খাতুন, ব্র্যাকের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং অভিবাসন কর্মসূচির পরিচালক সাফি রহমান খানসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।