গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। এদিন হামলার শিকার হওয়া থেকে বাদ যায়নি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদারব থানাও। হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটে নেওয়া হয় যানবাহন, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। ছয়তলা থানা ভবনের তিনটি ফ্লোর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পরে ভবন সংস্কার করে থানার কার্যক্রম শুরু করা হলেও এখনও পরিবহন, লোকবল ও অন্যান্য সরংঞ্জাম সংকট রয়ে গেছে। হামলার কারণে মানসিক আঘাত এবং ফের একই ধরনের আচমকা আক্রমণের আতঙ্ক রয়ে গেছে পুলিশ সদস্যদের মনে।
সরকার পতনের প্রায় এক সপ্তাহ পর ১২ আগস্ট থেকে আদাবর থানার কার্যক্রম শুরু করে পুলিশ। থানার ওসিসহ বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যদের বদলি করা হয়েছে, দেওয়া হচ্ছে নতুন মুখ। পুলিশের দাবি, বিগত সময়ে পুলিশ সদস্যদের দলীয়ভাবে ব্যবহার করায় জনগণের রোষানলে পড়েছিল পুলিশ বাহিনী। তাই সরকার পতনের পর পুলিশকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক যাতে বন্ধুসুলভ হয় সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
আদাবর থানা ঘুরে দেখা যায়, এ থানায় ২৩ জন উপ-পরিদর্শক (এসআই), ২৭ জন সহকারী উপ-পরিদর্শকসহ (এএসআই) ১০৬ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। তবে এখনও এই থানায় যানবাহনসহ অন্যান্য সরঞ্জামের সংকট রয়েছে। অন্য থানা থেকে ধার করা তিনটি গাড়ি দিয়ে চলছে টহল ও অন্যান্য পুলিশি কার্যক্রম। এরমধ্যে একটি গাড়ি আবার নষ্ট।
থানার কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, মারামারি ও মাদক সংশ্লিষ্ট ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসময়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক অভিযোগ, হুমকি ও বিভিন্ন কিছু হারিয়ে যাওয়া অভিযোগে ৭৯২টি সাধারণ ডায়রি (জিডি) জমা পড়েছে এ থানায়।
থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুলিশের প্রতি জনসাধারণের বিরূপ মনোভাব অনেকাংশে কমেছে। তবে এখনও কিছু মানুষ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে রুক্ষ আচরণ করেন। নানা ইঙ্গিতে বিরূপ মন্তব্য করেন। এরপরও জনসাধারণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে পুলিশ।
তবে স্থানীয়দের দাবি, পুলিশ আগের মতো টহল দেয় না। ফলে ৫ আগস্টের পর থেকে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি বেড়েছে কয়েকগুণ।
মোহাম্মদপুর শনিরবিল এলাকার বাসিন্দা ও ঢাকা উদ্যান সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ইয়াসিন হাওলাদার জানান, শনিরবিলে তার একটি ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। সরকার পতনের পর থেকে তার দোকানে চাঁদার জন্য স্থানীয় একটি চক্র উৎপাত করছে। ইয়াসিনের মতো সেখানকার আরও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে স্থানীয় কয়েকটি চক্রের বিরুদ্ধে। ব্যবসায়ীদের দাবি, পুলিশের দুর্বলতার সুযোগে বেড়িবাঁধ এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে।
পুলিশ সদস্যরা বলেছে, জনতার হামলা বা যেকোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা মোকাবিলা এবং আসামি ধরতে যেতে হচ্ছে একাধিক পুলিশ সদস্যকে। জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়াও চেয়ে এখন নিজেদের নিরাপত্তাই আগে দেখছেন তারা। থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সাদেক মিয়া বলেন, বর্তমানে থানার কম্পিউটার থেকে শুরু করে অনেক কিছুই সংকট রয়েছে। তবুও আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এখন থানায় জিডি করতে বেশি মানুষ আসে। অধিকাংশ সময় আমরা নিজেরাই জিডি লিখে দিচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করার। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় হচ্ছে। পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে না করা শর্তে এক উপ-পরিদর্শক জানান, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এখনও নানাভাবে ভয়-ভীতি কাজ করছে। ৫ আগস্ট থানা থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট হয়েছে যা বেশিরভাগই এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যেকোনও সময় আবারও পুলিশের ওপর হামলার আতঙ্ক রয়েছে। এছাড়াও মাদক ও চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। আমরা চেষ্টা করছি অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার। তবে এখনও আমাদের অনেক কিছুর সংকট রয়েছে।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া বলেন, যানবাহন সংকট থাকায় এলাকাভিত্তিক টহল কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি ঠিকই, তবে আমাদের পুলিশ সদস্যদের মনোবল অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। এখন থানা এলাকার কোনও সমস্যার সৃষ্টি হলে সঙ্গে সঙ্গে রেসপন্স করা হচ্ছে। লজিস্টিক সাপোর্ট ও ইকুইপমেন্ট সংকট রয়েছে। পর্যায়ক্রমে পুলিশ সদর সফতর থেকে রিকুইজিশন দিয়ে বিভিন্ন সরঞ্জাম আনা হচ্ছে।
ওসি আরও বলেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু। এটা কথায় নয়, আমরা সত্যিকার অর্থেই জনগণের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করছি। পুলিশের সঙ্গে জনগণের সুসম্পর্ক স্থাপনের বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এছাড়াও জনসাধারণের মধ্যে পুলিশের প্রতি ক্ষোভ দূরীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
কী ঘটেছিল সেদিন
গত ৫ আগস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগ সরকার পতন ও শেখ হাসিনার ভারতে চলে যাওয়া খবরে লাখ লাখ মানুষ নেমে আসেন রাস্তায়। বিক্ষুদ্ধ জনতা বিভিন্ন পুলিশ বক্সে ও থানায় হামলা চালায়। আদাবর থানায় দুপুর থেকেই গেট বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান নেন দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য। বিকাল ৪টার দিকে আদাবর থানায় হামলা চালায় স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। তারা কলাপসিবল গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে থানার তৎকালীন ওসি মাহমুদের মাথায় আঘাত করে। এরপর পুলিশ সদস্য বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি করে শ্যামলীর দিকে চলে যান। সেখানেও উত্তেজিত জনতার হামলা শিকার হন পুলিশ সদস্যরা।
শ্যামলীতেও কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন পুলিশ সদস্যরা। এসময় ওসিসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনার সময় থাকা এক পুলিশ সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুপুরে আমাদের উদ্ধার করতে (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) এসএসএফের প্রায় ২০ জনের একটি টিম থানায় আসে। পরে তাদের সঙ্গে থানার প্রায় দেড় শতাধিক পুলিশ সদস্য প্রথমে শ্যামলীর দিকে যায়। সেখানেও বিক্ষুদ্ধ জনতা আমাদের ওপর নির্মমভাবে হামলা চালায়। যে যেভাবে পারে আমাদের মারধর করতে থাকে। লাটি, ইটপাটকেল এমন হাতে-পায়েও মারতে থাকে। শিশু মেলার সামনে সেনাবাহিনী আছে এমন সংবাদে আমরা সেখানে যাই। সেখানেও আমরা হামলার শিকার হই। পরে শের-ই-বাংলা নগর থানা হয়ে মিরপুর দিয়ে পুলিশ লাইন্সে (পিএমও) যাই। পুরোটা রাস্তায় আমরা হামলার শিকার হয়েছি। থানা থেকে বের হয়েছিলাম প্রায় দেড় শতাধিক পুলিশ। আর মিরপুর পুলিশ লাইন্সে গিয়েছি ৬০ জনের মতো। বাকিরা রাস্তা থেকে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে মারাও গিয়েছে।
পুলিশের এই সদস্য আরও বলেন, আমরা সবাই ভেবেছিলাম, সাবই মারা যাবো। আমরা কেউই আর বাঁচবো না। পুরো সময়টা শুধু আল্লাহর কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছিলাম। আমাদের হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। কোথাও গিয়ে আশ্রয় পাচ্ছিলাম না। আমাদের প্রত্যেকেই হামলার শিকার হয়েছিল। আমারও মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছিলো। আবার কারও হাত-পা এমনকি শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত ঝরছিল।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় লেগুনাচালক আফজাল হোসেন বলেন, বিকালে পুলিশের গুলিতে থানার সাদা সিঁড়ি রক্তে লাল হয়ে যায়। পুলিশরা থানা থেকে বের হওয়া সময় চারজনকে গুলি করে হত্যা করে। আবার শ্যামলীতে গিয়ে তারা আরও কয়েকজনকে গুলি করে। সেখানেও চারজন মারা যায়। পুলিশ যত গুলি করে মানুষ তাদের ওপর ততও ক্ষিপ্ত হয়। তবে সে সময় যেসব পুলিশ সদস্যরা মানুষের ওপর গুলি করেছিল, সেসব পুলিশদের এখন আর থানায় দেখা যায় না।
লুটপাট ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
৫ আগস্ট বিকালে আদাবর থানায় বিক্ষুদ্ধ জনতা হামলা চালালে প্রাণভয়ে থানা ছেড়ে পালিয়ে যায় পুলিশ সদস্যরা। এ সুযোগে থানায় সেরেস্তা কক্ষ (মামলা, জিডিসহ থানার নথিপত্রে কক্ষ), ডিউটি অফিসার, ওসির কক্ষ, পুলিশের থাকা জায়গা, মালগারসহ পাঁচতলা ভবনের বেশিরভাগ কক্ষে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং ব্যাপক লুটপাট করা হয়। এসময় থানার অস্ত্রগার ও মালগার থেকে সব কিছুই লুট করে নিয়ে লুটপাটকারীরা। চায়নিজ রাইফেল, চায়নিজ এসএমজি ও এলএমজি, ১২ বোর শর্টগান, বন্দুক, রিভলভার, পিস্তলসহ (চায়না/তরাশ/সিজেড) ১৭০টি অস্ত্র লুট করা হয়েছে। ২৩ সাউন্ড গ্রেনেড এবং শর্ট ও লংরেঞ্জের ১২৪টি টিআরশেল লুট হয়। এসময় বিভিন্ন অস্ত্রের ২ হাজার ৯৯৫ রাউন্ড গুলি লুট হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন মামলায় থানায় জব্দকৃত মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, ট্রাক ও সিএনজিসহ ৫৫টি যানবাহন এবং থানার ব্যবহৃত ১২টি গাড়ি আগুন ধরিয়ে দেওয়া ও লুট করা হয়েছে। পুলিশের ব্যবহৃত হ্যান্ডকাফ, ভেস্ট, ওয়াকিটকি,কম্পিউটার, প্রিন্টার, সিসি ক্যামেরা, ডিবিআর, এসি, দরজা-জানালাসহ প্রায় চার কোটি টাকার সমমূল্যের মালামাল লুট হয়েছে বলে থানা সূত্রে জানা যায়।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন জেলায় চ শতাধিক থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে রাজধানীর প্রায় ২২টি থানায় হামলা করা হয়।