আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁওয়ের বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনকে। সেসময় রাজধানীর বসুন্ধরা ও তেজগাঁও এলাকা থেকে সুমনসহ আরও আট জনকে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। সুমনকে খুঁজতে শুরু করেন তার বোন সানজিদা ইসলাম তুলি। একে একে তিনি আরও অনেক নিখোঁজ (গুম) ব্যক্তির পরিবারের সন্ধান পান। পরের বছর (২০১৪ সাল) এই পরিবারগুলোকে নিয়ে শুরু করেন সামাজিক অধিকার আদায়ের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’। প্রায় ১২ বছর ধরে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, প্রতিবাদসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন সানজিদা ইসলাম তুলি ও তার সংগঠন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার সাত শতাধিক ব্যক্তির তালিকা তাদের কাছে রয়েছে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান ‘মায়ের ডাকের’ প্রধান সমন্বয়ক সানজিদা। তার ধারণা, গুমের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
ভাইয়ের গুমের ঘটনা বর্ণনা করে সানজিদা ইসলাম তুলি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তেজগাঁওয়ে ওই সময়কার ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড (বর্তমানে ডিএনসিসি-২৫) বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আমার ভাই সাজেদুল ইসলাম সুমন। ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১) পরিচয়ে রাত সাড়ে ৮টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে সুমনসহ ছয় জনকে তুল নিয়ে যায়। যারা তুলে নেয় তারা অস্ত্রসজ্জিত ছিল এবং তাদের পরনে ছিল র্যাবের পোশাক। তিনটা ডাবল কেবিন ভ্যান আর একটা সাদা মাইক্রোবাস ছিল। এসব গাড়িতেও র্যাব-১ লেখা ছিল।’
তিনি জানান, ‘ওই দিনই রাত ১২টার দিকে শাহীনবাগ এলাকা থেকে আরও দুই বিএনপি নেতাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন রাস্তায় গাড়িতে সুমন ভাইসহ ওই ছয় জন ছিলেন। এটা সবাই দেখেছেন। এরপর তাদের কেউ আর ফিরে আসেননি।’
‘আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম যেহেতু রাষ্ট্রীয় বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে, হয়তো রাজনৈতিক কারণে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিছু দিন আটকে রাখবে। কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ছিল। সেই সময় বিরোধী দলের সদস্যদের গণহারে গ্রেফতার করা হচ্ছিল। আমাদের ধারণা ছিল নির্বাচনের পর ভাইকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ঘটনার পরপরই আমার মা, বোন, ভাই প্রথমে ভাটারা থানায় যান। কিন্তু র্যাব তাদের তুলে নিয়ে গেছে শুনে পুলিশ কোনও মামলা বা জিডি নেয়নি। এরপর র্যাব-১ অফিসে যাই। কিন্তু তারা বারবার অস্বীকার করে এরকম কাউকে তুলে আনেনি’- জানান তিনি।
প্রায় আড়াই বছর চেষ্টার পর মামলা করতে না পেরে ২০১৬ সালে ৩ মার্চ সাজেদুলের মা হাজেরা খাতুন ছেলেকে গ্রেফতার বা অপহরণ বা নিখোঁজের ওই ঘটনা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি একেএম সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। গুমের ওই ঘটনাকে কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, এক সপ্তাহের মধ্যে ১৩ জন বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। কিন্তু এরপর আর কোনও অগ্রগতি হয়নি।
সানজিদা বলেন, ‘আমার ভাইকে যখন নিয়ে যাওয়া হয় তখনও আমরা জানি না আসলে গুম ব্যাপারটা কী? কেন বেআইনিভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আইনের এমন প্রয়োগ আমরা আগে কখনও দেখিনি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো এমন অপরাধ সংঘটিত হয় সেটা আমাদের মতো সাধারণ পরিবারের জানা ছিল না। নির্বাচন হয়ে গেলো, তারপরও ভাইকে ছাড়ছে না এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিবারই আমাদের মতো পরিবারগুলোর কাছে অস্বীকার করছে, তারা তুলে নিয়ে যায়নি। আমরা অনেকবার র্যাব, ডিজিএফআই, পুলিশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন দিয়েছি। কোনও পরিবারই সেসব আবেদনের কোনও উত্তর পাচ্ছিল না। তখন আমরা মামলা করার চেষ্টা করি। যখন কোনও মামলাও করা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার মা প্রথম ওই আট পরিবার নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রথম ক্যাম্পেইন সেখান থেকেই শুরু।’
“আট জন দাঁড়ানোর পরে দেখা গেলো এরকম পরিবারের সংখ্যাটা আরও অনেক। তখন থেকে ‘মায়ের ডাকের’ কার্যক্রম শুরু। পরে ওই বছর ৩১ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবসে মায়ের ডাক-এর ব্যানারে গুমের শিকার ব্যক্তিদের ১০০ পরিবার নিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। তখন আমরা বুঝলাম, সারা দেশে এই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। এক এক করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সন্ধান আসতে থাকলো।”
‘মায়ের ডাক’ ১১ বছর শেষ করে ১২ বছরে পা দিয়েছে উল্লেখ করে সানজিদা বলেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনামলের ওই সময়টায় আমরা যখনই কোথাও দাঁড়ানোর চেষ্টা করতাম, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জায়গাগুলো ব্লক করে রাখতো। আমরা আধঘণ্টাও কোথাও ছবি নিয়ে দাঁড়াতে পারতাম না, ক্যাম্পেইন করতে পারতাম না।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও গুম হওয়া সব মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়নি– এই আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘অনেক ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে আমরা ৫ আগস্ট নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। অনেক আশা করেছিলাম, শেখ হাসিনা চলে গেছেন, তার শাসনামলের অপকর্মগুলো বন্ধ হচ্ছে! কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে দেখলাম আমাদের আশঙ্কাগুলো আরও বেশি বেড়ে যাচ্ছে। কারণ প্রতিটি দিন যাচ্ছে, কিন্তু আমরা গুম হওয়া ব্যক্তিদের কোনও সন্ধান পাচ্ছি না। সেক্ষেত্রে আমরা আবার ক্যাম্পেইন করলাম। ডিজিএফআই অফিসের সামনে অবস্থান করা, তাদের সঙ্গে মিটিং করা। বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের জানালাম।’
‘এসবের পর কিছু পদক্ষেপও তারা নিয়েছেন। খুব দ্রুত সময়ে একটি কমিশন হয়েছে। কিন্তু কমিশন কোন প্রক্রিয়ায় যাবে, পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কী হবে– কারণ প্রতিটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জানে প্রতিটি গুমের সঙ্গে কারা কারা জড়িত ছিল। তারা যদি স্বচ্ছ হয় তাহলে তাদের জানা উচিত, মানুষগুলোকে ফেরত দেওয়া উচিত। কিন্তু কমিশনের পক্ষ থেকে তারা সেটি করেনি। প্রায় এক মাসের বেশি হয়ে গেছে, কোনও প্রগ্রেস বা সন্ধান কিন্তু আমরা দেখিনি, পাইওনি। সেই জায়গা থেকে আমাদের ভেতরে ভীষণরকম ভয় কাজ করছে, সামনে আমরা কী দেখবো বা কী শুনবো। আমাদের প্রথম থেকে চাওয়া– গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান চাই। গুমের শিকার ব্যক্তিরা কি আদৌ বেঁচে আছেন, নাকি তাদের মেরে ফেলা হয়েছে? আমরা জানতে চাই। পরিবারগুলো আর অপেক্ষায় থাকতে চাইছে না।’
‘মায়ের ডাকের’ হিসাবে গুম হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে ৭০০-এর বেশি গুমের তথ্য আছে। সেগুলোর প্রত্যেকটার যথাযথ ইনভেস্টিগেশন সম্ভব হয়নি। লিস্টের বাইরেও কিন্তু বহু কেইস আছে, যারা আগে ভয়েস রেইজ করেনি, ভয়ে চুপ করে ছিল, জানতো না কীভাবে আসতে হবে বা বলতে হবে। তারা আশা ছেড়ে দিয়েছিল। সেই মানুষগুলো কিন্তু ৫ আগস্টের পরে সামনে আসছে। বলতে চাচ্ছে। সারা বাংলাদেশে খুঁজলে কিন্তু এই সংখ্যাটা অনেক বেশি হবে।’
‘আমরা যেমন একটা কমিশন চেয়েছিলাম, নিরপেক্ষ তদন্ত থাকবে এবং পরবর্তীতে যেন বিচার প্রক্রিয়াটা যথাযথ হয়। বর্তমান কমিশনের কাছে আমাদের সেটিই আশা। সেটি নিয়েই আমরা এখন কাজ করছি। আমরা আশা করছি, হয়তো গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাবো, বিচার পাবো, পরিবার জানবে তার স্বজনের কী হয়েছে এবং পরবর্তীতে যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিচারের আওতায় আনা, সিক্রেট সেলগুলোকে (আয়নাঘর) উন্মুক্ত করা। এই প্রক্রিয়াটা যেন আর না থাকে। অবৈধভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন যেন আর না হয় বাংলাদেশে।’
গুম প্রতিরোধে কোনও আইন চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইন তো লাগবেই। যেহেতু কনভেনশনে সাইন করেছে, আইন তো করবেই। সেই কাজও করছে অন্তর্বর্তী সরকার। যখন বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে, তখন হয়তো আইনটি চলে আসবে। ইতোমধ্যে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালও গঠন করা হয়েছে। এই বিচার প্রক্রিয়া যাতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। হয়তো সবকিছু সামনে জানতে পারবো।’
ছবি: সংগৃহীত।
আরও পড়ুন-