কোটা সংস্কার ও পরবর্তী সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনে নানা কারণে জনরোষের মুখে পড়ে পুলিশ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাপক আক্রমণের শিকারও হয় এই বাহিনী। এসময় দেশের বিভিন্ন থানা থেকে শুরু করে পুলিশ সদর দফতর, সংস্থাটির গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের ভবনে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কয়েকশ’ থানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ত একটি থানা হচ্ছে পল্টন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন অন্যান্য থানার মতো ক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের এই থানাটিও। এসময় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয় থানা ভবনে। আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া থানা ভবনটি এখনও বেহাল দশায় পড়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি নতুন করে মেরামতের কাজ চলছে। ফলে এখনও খোলা আকাশের নিচে ছাউনি টানিয়ে থানার সব কার্যক্রম চালাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ এই থানায় আসছেন জিডি ও বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে। এসব সেবাপ্রার্থীকে খোলা আকাশের নিচে বসেই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা।
গত ১০ সেপ্টেম্বর বিকালে সরেজমিন পল্টন থানা চত্বরে গিয়ে দেখা যায়— থানার চারতলা ভবনটিতে এখনও ধোয়ামোছা ও মেরামত কাজ চলছে। ভবনে বসে ডিউটি করার মতো পরিবেশ না থাকায় থানার পশ্চিম পাশে ছোট একটি ছাউনি টানিয়ে থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি), পরিদর্শক (তদন্ত), ডিউটি অফিসারসহ সবাইকে একসঙ্গে অফিস করতে দেখা গেছে। সেখানে গাদাগাদি করে বসানো দু-চারটি টেবিল আর চেয়ার ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি। নেই কোনও কম্পিউটারও। ফলে হাতে-কলমেই কাজ করতে হচ্ছে দায়িত্বরতদের। আর সেখানেই বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আসছেন সেবাগ্রহীতারা। বসার জায়গা সংকট থাকায় থানায় দায়িত্বরত অন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের ছাউনির চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এমন সংকটের মাঝে থানায় আসা লোকজনদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের।
রাজধানীর রামপুরা থেকে পল্টন থানায় অভিযোগ নিয়ে আসেন মো. জসিম (২৭) নামে এক গার্মেন্টস কর্মী। ছাউনির ভেতরে ওসির টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। কিছু দিন আগে বিদেশে যাওয়ার জন্য একজনকে টাকা দিয়েছিলেন। বিদেশে নিতে দেরি হওয়ায় জমা দেওয়া টাকা ফেরত পেতে পুলিশের সহযোগিতা চান তিনি। জসিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওয়ার্ক পারমিটসহ কানাডায় লোক নেওয়া হচ্ছে, ফেসবুকে এমন বিজ্ঞাপন দেখে ২ মাস আগে পল্টনে একজনকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম আমি। পরে বুঝতে পারি এভাবে কানাডায় যাওয়া সম্ভব নয়। এখন টাকা ফেরত চেয়েও পাচ্ছি না। এ কারণে পুলিশের সহযোগিতার নিতে থানায় এসেছি। তবে থানা ভবনে কাজ না হওয়ায় এখানে ভিড় বেশি।’
পল্টন থানার উল্টো পাশে বাসা মাহিনের। তার বাসার প্রাইভেটকার চালককে মারধর করেছে কিছু লোক। তাই অভিযোগ জানাতে থানায় এসেছেন। তিনি বলেন, ‘ছাউনির ভেতরে জায়গা কম। মানুষের ভিড় বেশি। অপেক্ষা করছি ওসির সঙ্গে কথা বলার জন্য।’ তাদের মতো অর্ধশতাধিক মানুষকে বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে ওই ছাউনির পাশে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
থানা সূত্রে জানা গেছে, এই থানার অধীনে ৪০ জন এসআই, ৪০ জন এএসআই, ৫০ জন কনস্টেবল এবং ২৫ জন আনসার সদস্যসহ ২ জন পুলিশ পরিদর্শক দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে বদলি প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও পল্টন থানার অফিসার্স ইনচার্জ ছাড়া এখনও কারও বদলি হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। ফলে যেকোনও সময় তাদের যে কারও বদলির অর্ডার আসতে পারে, এমনটি ধারণা করছেন থানার কর্মকর্তারা।
থানার একাধিক কর্মকর্তা জানান, পুরো ভবনটি হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার হয়েছে। এরপর থেকে থানায় আর বসার সুযোগ হয়নি তাদের। ডিউটি অবস্থায় তাদের বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তবে থানার আসবাবপত্র, মালামাল ও অস্ত্র লুট হলেও হামলার সময় থানার টহল গাড়িগুলো বাইরে থাকায় রক্ষা পেয়েছে। এ কারণে গাড়ির সংকট নেই পল্টন থানায়। গাড়ি নিয়ে টহলে বের হতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না তাদের। থানার আওতাধীন প্রতিটি এলাকায় নিয়মিত টহল দেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
পল্টন থানার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক সিন্টু মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হামলা ও অগ্নিসংযোগ করার সময় আমাদের থানার কেউ হতাহত হননি। তবে ভবনে থাকা সবকিছু ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। এর মধ্যে আটটি অস্ত্র লুট হয়েছে, সেগুলো এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অবকাঠামো। অবকাঠামো ঠিক হয়ে গেলে আমাদের সমস্যা দূর হয়ে যাবে বলে আশা করি। এ সংকটের মধ্যেই আমরা সবাই কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া থানার সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী কাজে ফিরে এসেছেন।’
এ প্রসঙ্গে পল্টন থানার ওসি মোল্লা মো. খালিদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত থানা ভবনটি মেরামতের কাজ চলছে। তা শেষ হতে আরও সময় লাগবে। ভবনে বসার মতো অবস্থা না থাকায় আমি যোগদান করার পর থেকে এ ছাউনিতে বসেই অফিস করছি। ছোট এটুকু জায়গায় আর কতজন বসবে! এখানে সবার বসা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের অফিসারদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। সেবাগ্রহীতাদের বেশি ভিড় হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের অভিযোগের কথা শুনতে হচ্ছে। বর্তমানে থানায় প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ জন মানুষ সেবা নিতে আসছেন। তাদের সেবা দিতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘কাজের চাপ প্রচুর। আমি সকালে ঢুকে গভীর রাত পর্যন্ত থানায় অবস্থান করছি। আমাদের নিয়মিত টহল চলমান আছে। এসবের মধ্যেই চেষ্টা করছি সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার।’