‘অভিযান-সেনা আমরা ছুটিব দলে দলে/ বনে নদীতটে গিরি-সঙ্কটে জলে-থলে।/ লঙ্ঘিব খাড়া পর্বত-চূড়া অনিমেষে, জয় করি' সব তসনস করি পায়ে পিষে−/ অসীম সাহসে ভাঙি লাগল!’ কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্রপথিক হে সেনাদল’ গানের রচনার মতোই আজ বাস্তবে প্রতিফলন ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির প্রাঙ্গণে।
কেউ রিকশায়, কেউ ভ্যানে, কেউবা অটোতে, কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে ত্রাণ নিয়ে হাজির হচ্ছেন টিএসসির গণত্রাণ সহায়তা কেন্দ্রে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কারও হাতে বিস্কুট, কারও হাতে পানি, কারও হাতে চিড়ামুড়ি। আবার অনেকে এসেছেন নগদ অর্থ নিয়ে। তাদের কাছ থেকে ত্রাণ সংগ্রহে কাজ করছেন শত শত শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবী। দিনভর এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছে টিএসসি প্রাঙ্গণে। এ যেন এক মানবতার মেলা।
প্রথম শ্রেণিতে পড়ে তিন বছর বসয়ী সাধ আব্দুল্লাহ। তিন বছর ধরে সে মাটির একটি ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছিল। রাজধানীর পল্টন থেকে বাবা-মায়ের হাতে ধরে সেই ব্যাংকটি নিয়ে চলে আসে টিএসসি প্রাঙ্গণে। তার ইচ্ছা, জমানো টাকা দিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াবে।
সাধ আব্দুল্লাহ বলে, ‘আমি টিভিতে দেখেছি মানুষ পানিতে অনেক কষ্ট করছে, তাই আমিও তাদের পাশে দাঁড়াতে বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছি।’ তার পাশেই দাঁড়ানো ব্যাংকার বাবা ইভান রেহান বলে ওঠেন, দেশের যেকোনও ক্রাইসিসে যে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি, আজ আরেকবার প্রমাণ হলো। আমরা ১৯৭১-এ যা দেখেছি, ২০২৪-এ এসেও একই জিনিস দেখছি।
সাধ আব্দুল্লাহর মতোই রাজধানীতে খীলক্ষেত থেকে মা-বাবার হাত ধরে হুইলচেয়ারে করে অর্থসহায়তা নিয়ে আসেন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু আয়ান ওয়াহিদ (১৯)। বুথে নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে হাত ওপরে উঠিয়ে হাসিমুখে বিজয়ের চিহ্ন দেখাচ্ছিলেন তিনি।
আয়ানের মা আইরিন রূপা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আয়ান তো কথা বলতে পারে না। টেলিভিশনে, ফোনে বন্যার দৃশ্যগুলো দেখে আমাদের আকার-ইঙ্গিতে সে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে বন্যার্তদের দেখে সে কষ্ট পাচ্ছে। তারপরই তার বাবা আর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে নিয়ে টিএসসিতে যাবো। আমরা হয়তো সরাসরি যেতে পারছি না। তবে আমাদের মন পড়ে আছে সেই বন্যাকবলিত এলাকায়।
শাজাহানপুর থেকে নগদ অর্থসহায়তা দিতে টিএসসিতে আসেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বেসরকারি চাকরিজীবী জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, তরুণ শিক্ষার্থীর এমন উদ্যোগ, পরিশ্রম, কষ্ট দেখে তো ঘরে বসে থাকতে মন চায় না। নিজের বিবেকের তাড়নায় এখানে ছুটি এসেছি সবাইকে উৎসাহ দিতে।
একইভাবে রাজধানীর বংশাল থেকে রিকশায় করে শুকনো খাবার নিয়ে এসেছেন গৃহিণী জুবেদা খাতুন (৪০)। তিনি বলেন, সাধ্যমতো কিছু নিয়ে এসেছি। আসুন আমরা যার যার জায়গা থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যার্তদের সহযোগিতা করি।
শুধু তারাই নন, এমন হাজারো মানুষ সাহায্য নিয়ে এসেছেন টিএসসিতে। সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকেও দেখা গেছে ত্রাণ নিয়ে হাজির হতে। এসব ত্রাণ সংগ্রহে কাজ করছেন শত শত শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবী।
সরেজমিনে দেখা যায়, ত্রাণ নিয়ে আসা গাড়িগুলো সারি সারি করে টিএসসিতে ঢুকছে। রোভার স্কাউটের সদস্যরা শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি করছে। মাইকে বারবার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, ‘গাড়িগুলো সারিবদ্ধভাবে যাবে, সবাই ফুটপাত দিয়ে হাঁটুন।’
টিএসসির প্রধান গেটে কয়েকটি টেবিল বসিয়ে অস্থায়ী বুথ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ১০ জনের অধিক স্বেচ্ছাসেবক ব্যস্ত হাতে ত্রাণগুলোর তালিকা ও প্রতিষ্ঠানের নাম লিপিবদ্ধ করছেন। অর্থসহায়তাও করছেন অনেকে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যস্ত আনাগোনা, দাঁড়ানোর জায়গা নেই বলা চলে। ত্রাণ বুথে লিপিবদ্ধ হওয়ার পর সেটি স্বেচ্ছাসেবকদের হাত ঘুরে টিএসসির ভেতরে যাচ্ছে। সেখানে প্যাকেজিং চলছে। টিএসসি ক্যাফেটেরিয়া ভরে ত্রাণগুলো রাখা হচ্ছে টিএসসির বারান্দায়।
ত্রাণ বুথে বসা এক স্বেচ্ছাসেবী বাংলা টিবিউনকে বলেন, যারাই ত্রাণ নিয়ে আসছেন, আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা যারা রয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে খালি করে ভেতরে নিয়ে স্টক করছেন। এসব ত্রাণ বন্যার্ত এলাকার জেলা প্রশাসকের সহযোগিতায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার ২২ আগস্ট সারা দেশে বন্যার্তদের জন্য গণত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। শনিবার তৃতীয় দিনেও টিএসসিতে চলে এই ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম।
গতকাল শুক্রবার কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই উদ্যোগে নগদ ও মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেলে জমা পড়ে ১ কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার ১৯৬ টাকা। এর মধ্যে নগদ অর্থ সংগ্রহ হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ২৩ হাজার ১৭৩ টাকা।