সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে সাম্প্রতিক সংঘাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালেই ৮১ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে ৬০ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়, বাকিরা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। হাসপাতালটিতে এখনও ২৭৫ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হতাহতদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ।
বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) সকালে ঢাকা মেডিক্যালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান এসব তথ্য জানান।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ যতজনকে ঢামেকে আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬০ জনই ছিলেন স্পট ডেড। তাদের মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। আর চিকিৎসাধীনদের মধ্যে ১৯ জন মারা গেছেন।’ এছাড়া আজ সকালে চিকিৎসাধীন দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে ঢামেক সূত্রে জানা গেছে।
এখনও আর ২৭৫ জন ঢামেকে চিকিৎসাধীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসাধীনদেরও অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ।’
আজ সকালে যারা মারা গেছেন তারা হলেন, জামান (১৭) ও জাকির হোসেন (২৩)। নিহত জামান ময়মনসিংহের নান্দাইলের বাসিন্দা। তিনি পেশায় পোশাক কারখানার শ্রমিক ছিলেন। গত রবিবার (২১ জুলাই) নরসিংদীতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। আর জাকির হোসেন পটুয়াখালীর দশমিনার বাসিন্দা। তিনি থাকতেন যাত্রাবাড়ী এলাকায় রায়েরবাগে। রবিবার বাড়ির পাশেই সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
তবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের একটি সূত্রে জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সংঘর্ষের ঘটনায় গত ১৭ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতাল মর্গে ৯০ জনের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে ৮২টি মরদেহ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর বাকি অজ্ঞাতনামা ৮টি মরদেহ জনকল্যাণ সংস্থা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগই গুলিবিদ্ধ।
পরে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের দাফন সেবা অফিসার কামরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অজ্ঞাত মরদেহ দাফন করা আমাদের একটি নিয়মিত কাজ। বুধবার ঢামেক থেকে ৮টি মরদেহ ও সোমবার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে দুটি মরদেহ আমরা দাফন করেছি।
তথ্যের গরমিলের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা মূলত চিকিৎসার বিষয়টা দেখছি। মরদেহ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় পুলিশ জড়িত। এখন পর্যন্ত আমরা যাদের চিকিৎসা দিয়েছি, সেই হিসাবটা জানালাম। অন্যদের বিষয়ে পুলিশ জানাতে পারবে।’
পরে এ বিষয়ে জানতে শাহবাগ থানায় যান এই প্রতিবেদক। সেখানে কথা হয় ডিএমপির রমনা জোনের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব তথ্য এখন কোনও থানায় পাবেন না।‘ বিস্তারিত তথ্যের জন্য পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া উইংয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। তবে পুলিশের মিডিয়া উইংয়ে যোগাযোগ করেও এ বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সহিংসতায় ২০১ জন নিহতের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও গতকাল বুধবার (২৪ জুলাই) এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কিছু জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘জনসাধারণ কতজন মারা গেছেন, তার কোনও হিসাব আমাদের কাছে নেই। কোনও থানায় এ সংক্রান্ত কোনও মামলাও দায়ের হয়নি। পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করছে, এ বিষয়ে পরে বলা যাবে।’
তবে সংঘর্ষ চলাকালে তিন জন পুলিশ সদস্য এবং একজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আরও জানান, এসময় ১ হাজার ১১৭ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত ১৩২ জন। তিন জন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রয়েছেন।
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপির জনসংযোগ শাখা থেকে মঙ্গলবার জানানো হয়, নিহত আনসার সদস্যের নাম মো. জুয়েল শেখ (২২)। তার বাড়ি ফরিদপুরের মধুখালীতে। তিনি মতিঝিল থানায় অঙ্গীভূত আনসার সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
এছাড়াও সংঘর্ষে চার জন সাংবাদিক মারা গেছেন। নিহতদের বেশির ভাগের শরীরে গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। এছাড়াও যারা আহত অনেকে চোখে রাবার বুলেট ও ছররা গুলি এবং শরীরের অন্যান্য জায়গায় গুলির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে তা আরও ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ বেশি হয়েছে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে। ১৭ জুলাই থেকে সারা দেশে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরের দিন বন্ধ হয় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। এছাড়াও ১৯ জুলাই (শুক্রবার) রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী।
প্রায় পাঁচ দিন পর মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) রাতে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করে সরকার। তবে এখনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনেক ওয়েবসাইট ব্যবহার করতে পারছেন না ব্যবহারকারীরা। এছাড়াও মোবাইল ইন্টারনেট কবে নাগাদ চালু করা হবে তার সুনির্দিষ্ট করেনি বিটিআরসি।