X
রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
১৪ বৈশাখ ১৪৩২
কোটা সংস্কার আন্দোলন

যেমন ছিল পুরান ঢাকার শুক্রবার

আতিক হাসান শুভ
২৪ জুলাই ২০২৪, ১৯:২৮আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৪, ২১:২৯

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের বিচারের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো অঘোষিত ‘কমপ্লিট শাট ডাউন’ চলছিল সারা দেশে। শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা নাগাদ পুরান ঢাকায় বিশেষ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় ছিল সুনসান নীরবতা। আশেপাশে তেমন কোনও গণপরিবহন চলাচলের দৃশ্য দেখা না গেলেও রিকশা এবং সিএনজি চলেছে থেকে থেকে। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। বেলা ১১টার পর বাহাদুর শাহ পার্ক এলাকায় একে একে জড়ো হতে থাকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শ’খানেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে জড়ো হয়ে আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদসহ সবার হত্যার বিচার চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হন কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, মহানগর মহিলা কলেজসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। অনেকে ঢাকায় চাকরির পরীক্ষা দিতে এসেও আন্দোলনে যোগ দেন। আগের দুই দিন পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী হত্যার বিচার চেয়ে নানা স্লোগান দিতে থাকেন তারা। খানিক বাদেই পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে সাদা পোশাকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জবি শাখার সমন্বয়ক নূরনবীকে জোরপূর্বক করে তুলে নিয়ে যায়।

আন্দোলনের সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা বিতর্কে জড়ায় পুলিশের সঙ্গে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ঢুকে বিক্ষোভ মিছিল করতে চায় বারবার। কিন্তু ভিসির নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয় গেটে পুলিশের কড়া নিরাপত্তা। কোনোভাবেই ভেতরে যেতে দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় পুলিশ। বিতর্কের একপর্যায়ে পুলিশ টিয়ারশেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে।

ঘড়িতে তখন দুপুর  সাড়ে ১২টা। চারদিকে জুমার নামাজের আজান চলছে। এর মাঝেই একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ারশেলের গন্ধে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জুমার নামাজের আগেই পুলিশ আর শিক্ষার্থীদের দুই দফা সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়। তখন পর্যন্ত নিহতের কোনও ঘটনা ঘটেনি। পরে স্থানীয় বাসিন্দারা বাসা থেকে বের হয়ে এসে সংঘর্ষে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এর মাঝেই আন্দোলনকারীরা সড়কের ওপরেই জুমার নামাজ আদায় করেন।

শুক্রবার পুরান ঢাকায় অঘোষিত কমপ্লিট শাট ডাউনে আন্দোলনকারীরা

শিক্ষার্থীদের অনুরোধ শোনেনি পুলিশ

জুমার নামাজ শেষ হতেই পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আরেক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরপর অবশ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আন্দোলনকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী পুলিশের কাছে এসে অনুরোধ জানায় কোনও হামলা না করার জন্য এবং তাদের ক্যাম্পাসের প্রবেশদ্বার ছেড়ে দিতে। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের অনুরোধ আমলে নেয়নি। পুলিশের সরাসরি জবাব ছিল, ‘আপনাদের ভিসির নির্দেশনায় আমরা এখানে এসেছি। আপনারা ওনার সঙ্গে কথা বলেন। উনি যদি নির্দেশ দেন তাহলে আমরা চলে যাবো। আপনাদের আটকাবো না।’ তখন শিক্ষার্থীরা উচ্চস্বরে বলতে থাকেন- ‘ক্যাম্পাস তো শিক্ষার্থীদের, ভিসির বাপের না।’

এরপরই শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে পুলিশকে ‘ভুয়া ভুয়া’ দুয়োধ্বনি দিতে থাকে। এছাড়াও ‘আমার ভাই মরলো কেন- বিচার চাই বিচার চাই’, ‘কোটা না মেধা- মেধা মেধা’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। এরপর পুলিশ যেন সড়ক ছেড়ে দেয় সে জন্য তারা পুলিশের ওপর ইট নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে পুলিশ ক্ষেপে গিয়ে একের পর এক টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট মারতে থাকে। দফায় দফায় থেমে থেমে এভাবে সংঘর্ষ চলতে থাকে বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত। তখন পর্যন্ত নিহতের কোনও ঘটনা ঘটেনি। তবে আহতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক পেরিয়েছে। আহতদের রক্তাক্ত অবস্থায় রিকশায় করে আশপাশের হাসপাতালগুলোতে নেওয়া হয়েছে।

সাড়ে চারটার পর পুলিশ রাস্তার ওপরে বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে দুপুরের খাবার খায়।‌ খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই খবর আসে পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকারী একজন লক্ষ্মীবাজার এলাকার পাতলা খান লেনে মারা গেছে। আরেক মহিলা গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন। পরে দুজনকেই ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। তখন পর্যন্ত তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

রাস্তার পড়ে আছে গুলিতে পুলিশের ছোড়া বুলেট

গ্রেনেডের বিকট শব্দে পশু-পাখির চিৎকার

পুরান ঢাকায় পাখির অভয়ারণ্য বাহাদুর শাহ পার্ক। চড়ুই, শালিক, কাকসহ বিভিন্ন ধরনের পাখির দেখা মেলে এখানে। মাঝে-মধ্যে কাঠবিড়ালি দেখা যায়। পুরান ঢাকার বিভিন্ন ভবনের ছাদজুড়ে দেখা যায় বানরের সমারোহ। এদিন পুলিশের ছোড়া সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দে পাখিগুলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভয়ে উড়ে বেড়িয়েছে। বানরগুলো আতঙ্কে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে লাফিয়েছে। পাখির ডাক আর বানরের চিৎকারে পুরান ঢাকার আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। কুকুরগুলো ভয়ে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে লুকিয়ে পড়ে।

শুক্রবারের পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে পুরান ঢাকার বাসিন্দা সিরাজ সিকদার (৫৫) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুরান ঢাকায় এমন গোলাগুলি গত দুই দশকেও দেখিনি। দুই-তিন মিনিট পরপর গ্রেনেডের শব্দ। টিয়ারশেলের ধোঁয়া বাসাবাড়িতে ঢুকে গেছে। আমার নাতি-নাতনিরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আশপাশে সবাই টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে গেছে। আমরা মানুষরা তো বাসাবাড়িতে একটু নিরাপদ ছিলাম, বাইরে থাকা পশু-পাখির চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠেছে। গ্রেনেডের শব্দে বানরের চিৎকার চেঁচামেচি, পাখির ওড়াউড়ি চলতে থাকে। কুকুরগুলো ভয়ে বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।’

পুলিশের গুলিতে আঘাতের আলামত

বিকালের পর আক্রমণাত্মক ছিল পুলিশ

বিকাল পাঁচটার দিকে পুলিশ আক্রমণাত্মক আচরণ করতে থাকে। আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিয়ে কবি নজরুল কলেজের সামনে থেকে একেবারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ পর্যন্ত নিয়ে যায়। এ সময় আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন অলিগলিতে আশ্রয় নেয়। পুলিশ সেসব অলিগলি না চিনলেও সঙ্গে থাকা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের নেতাকর্মীরা তথ্য দিতে থাকে পুলিশকে। পরে পুলিশ সেখানে ঢুকে এলোপাতাড়ি সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও গুলি চালাতে থাকে। সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত অন্তত দুইশত সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছুড়েছে পুলিশ। তখন পুরো পুরান ঢাকাজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। বিকট শব্দে বাসাবাড়ি থেকে বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।

এর মধ্যে শোনা যায় কবি নজরুল সরকারি কলেজের দুই জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। তারা হলেন ওমর ফারুক ও জিহাদ। ওমর ফারুক কবি নজরুল কলেজের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী। জিহাদ ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী।

তাদের দুজনের লাশ সারা রাত ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের মর্গে পড়ে ছিল। এছাড়াও বিসমিল্লাহ হোটেলের গলিতে এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে আন্দোলনকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাশেদুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা দেখি পুলিশ বিরিয়ানি খেতে বসেছে। এই সুযোগে আমরাও বিস্কুট, কেক, পানি এসব খাচ্ছিলাম। আমাদের সঙ্গে এলাকার ও আশপাশের সাধারণ মানুষ ছিল। এলাকার মানুষ আমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। হঠাৎ পুলিশ এসে গলিতে গুলি চালায়। বিস্কুট খাওয়া অবস্থায় একজনের মাথায় গুলি লাগলে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। তখন আরও ১০-১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়। আমরা দৌড়ে গলির ভেতরে চলে যাই। পুলিশ সেদিকেও একের পর এক সাউন্ড গ্রেনেড আর টিয়ারশেল মারতে থাকে।’

মহানগর মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী তাশফি ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা পুলিশকে গুলি না চালানোর অনুরোধ করলেও তারা শোনেনি। অসংখ্য শিক্ষার্থীর বুকে গুলি লেগেছে। লক্ষ্মীবাজার এলাকায় অন্তত দুইশত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছে। পুলিশের গ্রেনেড আর টিয়ারশেল শেষ হয়ে গেলে তারা আবার কার্টনে করে এগুলো নিয়ে আসে। দুপুর থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত পুলিশ নির্বিচারে গুলি করেছে, আমার ভাইদের মেরেছে।’

এনএসআই’র তথ্যমতে, পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায় শতাধিক আন্দোলনকারী আহত এবং চার জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও দুই জন পুলিশ সদস্য এবং একজন আনসার সদস্য আহত হয়েছেন। একজন পুলিশ অফিসার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

/আরআইজে/এমওএফ/
টাইমলাইন: কোটা আন্দোলন
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০০
০৫ আগস্ট ২০২৪, ১৫:২২
০৪ আগস্ট ২০২৪, ২১:৩৭
সম্পর্কিত
ঢাকায় এনসিপির বিক্ষোভ সমাবেশ ২ মে
ইউআইইউতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ভিসিসহ ১০ শিক্ষকের পদত্যাগ
নারীর ফাঁদে পড়ে বেকায়দায় সরকারি কর্মকর্তা, গ্রেফতার ৪
সর্বশেষ খবর
স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার ওপর হামলা: গোপালগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগ নেতা কারাগারে
স্বেচ্ছাসেবক দল নেতার ওপর হামলা: গোপালগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগ নেতা কারাগারে
ইরানের বন্দরে রাসায়নিক বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ১৮
ইরানের বন্দরে রাসায়নিক বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ১৮
নেপালে ‘জিনিয়াস অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন সাংবাদিক কায়সার হামিদ হান্নান
নেপালে ‘জিনিয়াস অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন সাংবাদিক কায়সার হামিদ হান্নান
সৌদি আরবকে এশিয়ার তৃতীয় সেমিফাইনালিস্ট উপহার দিলো আল নাসর
সৌদি আরবকে এশিয়ার তৃতীয় সেমিফাইনালিস্ট উপহার দিলো আল নাসর
সর্বাধিক পঠিত
বড় দুই বাজারে রফতানিতে চমক: চীনের ঘাটতি পূরণ করছে বাংলাদেশ
বড় দুই বাজারে রফতানিতে চমক: চীনের ঘাটতি পূরণ করছে বাংলাদেশ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেনে ঢিল ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেনে ঢিল ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা
প্রবেশন কর্মকর্তা গোলাম রব্বানীর কারাদণ্ড, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
প্রবেশন কর্মকর্তা গোলাম রব্বানীর কারাদণ্ড, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
কর্মচারীদের সমান উৎসব ভাতা পেতে যাচ্ছেন বেসরকারি শিক্ষকরা
কর্মচারীদের সমান উৎসব ভাতা পেতে যাচ্ছেন বেসরকারি শিক্ষকরা
ভ্যাটিকান সিটিতে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার শুভেচ্ছা বিনিময়
ভ্যাটিকান সিটিতে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার শুভেচ্ছা বিনিময়