চলতি বছর বর্ষা যেমন দেরিতে শুরু হয়েছে, তেমনই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেরিতে দেখা যাচ্ছে। এ বছর এখনও পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ৪৮ জন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ এবং যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা যে সম্ভব, সেটা বিশ্বে বহু দেশে প্রমাণিত হয়েছে। সরকার ও নাগরিকরা যৌথভাবে কাজ করলে, বাংলাদেশেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ডেঙ্গুজনিত প্রতিটি মৃত্যুকে রুখে দেওয়াও সম্ভব বলে এসব তথ্য জানিয়েছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বারসিক।
রবিবার (১৪ জুলাই) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি হলে আয়োজিত ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান ও করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় উপস্থাপিত ধারনাপত্রে এসব কথা বলা হয়। ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পবার নির্বাহী সভাপতি ডা. লেলিন চৌধুরী। আলোচনা সভা যৌথভাবে আয়োজন করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক)।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত সংক্রামক ভাইরাসজনিত রোগ। ডেঙ্গু ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ কয়েকটি শহরে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এর মাঝে সুসমন্বিত কার্যকর উদ্যোগের অভাবে দিন দিন এডিস মশার উৎপাত বেড়েছে। এ অবস্থায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা করে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
ধারণাপত্রে বলা হয়, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দুটি অংশ রয়েছে। একটি হচ্ছে, এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ এবং অপরটি হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা।
এসময় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও বারসিকের পক্ষে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন ডা. লেনিন চৌধুরী।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পবা ও বারসিকের পরামর্শ
মশা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্বাস্থ্য বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিতভাবে কাজ করবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনসাধারণকে যুক্ত করতে হবে। মশক নির্মূলে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ, জিনগত নিয়ন্ত্রণ এবং জৈব নিয়ন্ত্রণ বা বায়োলজিকাল কন্ট্রোলের যুগপৎ এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী বা প্রয়োজনভিত্তিক প্রয়োগ করা। রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর, পরিবেশবান্ধব মশা বিধ্বংসী ওষুধ প্রয়োগ করা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে পাড়া মহল্লায় সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা। এই কমিটি ডেঙ্গু, করোনা ইত্যাদি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে জাতীয় গাইডলাইন অনুযায়ী ভূমিকা রাখবে। প্রয়োজনে তাদেরকে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। সারা দেশে পরপর তিনদিন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্বে মানুষের বাড়িঘর এবং আশেপাশের ঝোপঝাড়ে এডিস মশার প্রজনন স্থল ও বাসস্থান বিনষ্ট করতে হবে। একইসঙ্গে মশা মারার ওষুধ ছিটানো হবে। একটি বাড়ি বা অফিসও বাদ যাবে না এবং প্রতিরোধ কমিটির সদস্যরা প্রতিটি বাড়ির বাসিন্দাদের এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে নিয়মিত সহযোগিতা করবেন।
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় করণীয়
সভায় বলা হয়, প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ডেঙ্গুর অ্যান্টিজেন পরীক্ষা সহজলভ্য এবং বিনামূল্যে করতে হবে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ডেঙ্গুরোগীর সুচিকিৎসার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা। ঢাকাকেন্দ্রিকতা থেকে বের হয়ে দেশের বেশিরভাগ মানুষ যাতে স্থানীয় চিকিৎসাসেবার ওপর আস্থাশীল হয়, সেজন্য কর্তৃপক্ষকে যত্নশীল হওয়া। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জাতীয় গাইড লাইন অনুযায়ী ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করা। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সর্বস্তরের প্রস্তুতি রাখা। স্কুলগামী শিশুদের জন্য জাপানের তাকেদা ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন দ্রুত আনার ব্যবস্থা করা। ২০২৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৬ থেকে ১৬ বছরের শিশুদের জন্য এই ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন প্রদান করেছে। প্রতিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালকে আইনি বাধ্যকতার আওতা আনা, যেন প্রতিটি ডেঙ্গু পজিটিভ রোগীর তথ্য সঠিক সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার সংস্থাকে জানানো হয়।
পবার সহ-সভাপতি হাফিজুর রহমান ময়নার সভাপতিত্বে এসময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন— স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. রুমানা হক, পরিবেশ বিষয়ক বিশিষ্ট লেখক ও বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ প্রমুখ।