ঢাকার সাভারের প্রয়াত সংসদ সদস্য ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শামছুদ্দোহা খান মজলিশের বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত করতো ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায়। একপর্যায়ে শামছুদ্দোহা খানের বড় মেয়ে শামীমা খান মজলিশ ওরফে পপির সঙ্গে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে সুবল। ঘটনা জানাজানি হলে ওই বাড়িতে সুবলের যাতায়াত বন্ধ করে দেন শামছুদ্দোহা খানের স্ত্রী সেলিমা খান মজলিশ। এরপরও সুবল ও শামীমার যোগাযোগ চলতে থাকে। সেলিনা খান বিষয়টি জেনে যাওয়ায় তাকে থামাতে ছুরিকাঘাত করে শামীমা খান। মৃত্যু নিশ্চিত করতে সেলিমা খানের মাথায় ইলেকট্রিক শক দেয় সুবল।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) হেডকোয়ার্টার্সে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।
এর আগে, সম্প্রতি সাভার থানার ভাগলপুর ও পাকিজা এলাকা থেকে তিন জনকে গ্রেফতার করে পিবিআই। তারা হলো– সুবল কুমার রায়, শামীমা খান মজলিশ ওরফে পপি এবং ওই বাড়ির গৃহকর্মী আরতি সরকার।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৪ জুন সকালে নিজ বাসায় গলা ও পেটের নিচের অংশে গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়েছিলেন সেলিমা খান। পরিবারের লোকজন এবং প্রতিবেশীরা তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয় সেলিমা খানকে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ জুন তার মৃত্যু হয়।
এরপর নিহতের ভাই মো. শাফিউর রহমান খান ওরফে শাফি বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে সাভার মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে থানা-পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির তদন্তভার সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়।
সিআইডির তদন্ত
সিআইডির তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. আবু বকর সিদ্দিক ২০১১ সালের ২৪ জুন থেকে ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত মামলাটি তদন্ত করেন। তদন্তকালে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আবুল কালাম আজাদ, হরিপদ সরকার এবং মো. আবু সুফিয়ান ওরফে রানা নামে তিন জনকে গ্রেফতার করেন। তদন্ত শেষে তিনি মামলা থেকে ওই তিন জনকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
মামলাটি পুনঃতদন্ত হওয়ার কারণ
সিআইডি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিলে বাদীপক্ষ মামলাটি পিবিআইয়ের সহযোগিতায় পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করে ব্যর্থ হয়। পরে বাদীপক্ষ বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনেন। মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে বলে পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক মো. সালাহ উদ্দিন মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন। পরে মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন আদালত।
পিবিআইয়ের তদন্ত
পিবিআইয়ের ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মামলাটির তদন্তভার উপপরিদর্শক (এসআই) সালেহ ইমরানের কাছে অর্পণ করেন। তদন্তভার গ্রহণ করে মামলাটির কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। ২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী তদন্তভার পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ইমরান আহমেদের কাছে অর্পণ করেন সালেহ ইমরান।
পিবিআই তদন্ত শুরু করে যেভাবে
বনজ কুমার মজুমদার সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে নির্দেশনা আসে। পিবিআই ঘটনার তদন্ত শুরু করে। পরে নিহতের বড় মেয়ে শামীমা খানের পাশাপাশি বাকি দুই মেয়েকেও সন্দেহ করা হয়। খোঁজ করা হয়, ওই বাসায় কারা যাতায়াত করতো। জানা যায়, একজন ইলেকট্রিশিয়ান মাঝে মাঝে বাসায় আসতো। কিন্তু বহু দিন তার ওই বাসায় আসা-যাওয়া নেই। সে ৩০ বছর ধরে সাভার থানায় ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ করছে। সেই সঙ্গে পাশেই তার একটি বড় মুদি দোকানও রয়েছে। কিন্তু তদন্তকালে জানা যায়, নিহতের রুমের ইলেকট্রনিক সুইচ বোর্ড ভাঙা এবং দুটি ইলেকট্রনিক তার বের করে রাখা হয়েছে। এরপর ইলেকট্রিশিয়ান সুবল কুমার রায়কে নিয়ে আসা হয়।
পিবিআই প্রধান বলেন, সুবলকে গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, শামীমা খান তার স্বামীকে নিয়ে ভবনের নিচতলায় বসবাস করতো। সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতো সুবল। একপর্যায়ে শামীমা খানের স্বামীর সঙ্গে ব্যবসাও করে সে। ২০০১ সালে সুবল ও শামীমা বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি ২০০৫ সালে জানাজানি হলে সুবলকে বাসায় আসতে নিষেধ করা হয়। ২০০৮ সালে সুবল বিয়ে করে। ২০১১ সাল থেকে সে আবার ওই বাসায় যাতায়াত শুরু করে।
তিনি বলেন, ঘটনার দিন ভোরে ফজরের নামাজের সময় সেলিমা খান ছাদে ওঠেন। সেখান থেকে দেখতে পান সুবল চুপি চুপি তার বাড়ির দিকে আসছে। এরপর তিনি চিৎকার করতে করতে নিচে নামেন। তখন সুবল ও শামীমা তাকে থামাতে উপরে যায়। থামানোর জন্য শামীমা খান তার মাকে জাপটে ধরে। পাশে থাকা একটি ফল কাটার চাকু দিয়ে গলার দুই পাশে তিনটি পোচ দেয়। পরে সুবল ইলেকট্রিক বোর্ড ভেঙে সেখান থেকে দুটি তার বের করে সেলিমা খানের মাথায় শক দেয় এবং মৃত্যু নিশ্চিত করে।