X
মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪
১৮ আষাঢ় ১৪৩১
হোলি আর্টিজানে হামলার আট বছর

কোণঠাসা জঙ্গি সংগঠনগুলো এখনও সক্রিয় অনলাইনে

নুরুজ্জামান লাবু
০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০১আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০১

রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার আট বছর পূর্তি হলো আজ (১ জুলাই)। ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানামুখী তৎপরতার কারণে হামলায় অংশ নেওয়া নব্য জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। জঙ্গি সংগঠনগুলো জোরালোভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম না চালাতে পারলেও এখনও সক্রিয় রয়েছে অনলাইনে। সংশ্লিষ্টরা জানান, জঙ্গি সংগঠনগুলো বিভিন্ন নামে অনলাইনে সক্রিয় থেকে গোপনে সদস্য সংগ্রহ করছে। বছরখানেক আগে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে একটি সংগঠনের নামে তৎপরতা শুরু হয়েছিল। সর্বশেষ কক্সবাজার থেকে আস শাহাদাত নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কৌশলগুলো মাথায় রেখে জঙ্গিরাও ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। এমনকি কারাগার থেকেও অনেক জঙ্গি সদস্য তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় জঙ্গি হামলায় দেশি-বিদেশি নাগরিক ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জন নিহত হন। এর মধ্যে ইতালির নাগরিক নয়, জাপানের সাত, ভারতীয় এক ও তিন জন বাংলাদেশি নাগরিক। পরে র‌্যাব ও পুলিশের সহায়তায় সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গি নিহত হন। এছাড়া ঘটনাস্থলে একজন শেফ ও পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজন রেস্তোরাঁ কর্মী নিহত হন। এই ঘটনায় বিচার শেষে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন।

নব্য জেএমবিসহ অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর কী অবস্থা?

আলোচিত হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় অংশ নেওয়া জঙ্গিরা নিজেদের আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর সদস্য হিসেবে দাবি করেছিল। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে নব্য জেএমবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। একে একে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকে গ্রেফতার করা হয়। বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন অনেক শীর্ষ জঙ্গিও।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, নব্য জেএমবি একেবারেই কোণঠাসা হয়ে আছে। বর্তমানে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বিদেশে বসে আবু আব্বাস আল বাঙালি নামে এক তরুণ অনলাইনের মাধ্যমে নব্য জেএমবির কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে নব্য জেএমবি আইএসের ভাবাদর্শে পরিচালিত হতো। ইরাক ও সিরিয়া থেকে ইসলামিক স্টেট নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর দেশেও নব্য জেএমবি সদস্যরা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল  হয়ে পড়ে। এখন তারা নানা নামে অনলাইনকেন্দ্রিক সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)-এর প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, জঙ্গিদের সাংগঠনিক ভিত্তি একেবারেই দুর্বল হয়ে এসেছে। সাইবার দুনিয়াসহ সর্বত্রই তাদের ওপর মনিটরিং চলছে। কোনও ধরনের আক্রমণ করার মতো শক্তি নেই জঙ্গিদের।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নব্য জেএমবির মতো পুরোনো জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদও বর্তমানে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে আছে। পুরোনো জেএমবির একজন শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন প্রায় দশ বছর ধরে পলাতক থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি এই জঙ্গি নেতা আস-শাহাদাত নামে নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সদস্য রিক্রুট করছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম বলেন, হোলি আর্টিজানের পৈশাচিক ঘটনার পর থেকে র‌্যাবসহ অন্যান্য সংস্থা অনেক কাজ করেছে। আমাদের সক্ষমতাও বেড়েছে। আমরা বহু জঙ্গিকে আইনের আওতায় এনেছি। এতটুকু বলতে পারি, জঙ্গিদের একযোগে হামলা কিংবা নাশকতার ক্ষমতা এখন আর নেই।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, তবে জঙ্গিরা এখন নানা নামে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ছদ্মনাম দিয়ে কর্মী সংগ্রহ ও দাওয়াতি কার্যক্রমের চেষ্টা করছে। আমরা নিয়মিত নজরদারি করছি। সর্বশেষ আস-শাহাদাত নামের একটি সংগঠনের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

হোলি আর্টিজান বেকারি এখন আবাসিক ভবন (ফাইল ছবি)

এখনও শঙ্কা আনসার আল ইসলামকে নিয়ে

জঙ্গি সংগঠনগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে—আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা দাবি করলেও এখনও শঙ্কা রয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামকে নিয়ে। ২০১৩ সালে ব্লগার, লেখক-প্রকাশকদের টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে আলোচনায় আসা এই সংগঠনের আগে নাম ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই সংগঠনের বেশিরভাগ সদস্যই তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ। এছাড়া ‘কাটআউট’ পদ্ধতিতে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর কারণে এই সংগঠনের শীর্ষ অনেক নেতাই এখনও অধরা। এমনকি দেড় বছর আগে পুরোনো ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে ফিল্মি স্টাইলে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গিকে এখনও গ্রেফতার করা যায়নি।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে নিয়োজিত কর্মকর্তারা জানান, একসময় আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক গুরু ছিল জসিম উদ্দিন রাহমানী। তাকে গ্রেফতারের পর নরসিংদীর একটি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল গফুর নামে এক ব্যক্তি এই সংগঠনের দায়িত্ব নেন। এছাড়া সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এই সংগঠনের সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই জিয়াকে গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিটি মরিয়া চেষ্টা চালালেও এক যুগেও তার নাগাল পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জিয়া উচ্চশিক্ষিত ও তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক দক্ষ। সে সংগঠনের সদস্যদের এমনভাবে পরিচালিত করে, যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরতে না পারে। জিয়ার নেতৃত্বে থাকা আনসার আল ইসলামের সদস্যরা সর্বশেষ ২০১৭ সালে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল। এরপর থেকে সাংগঠনিকভাবে তারা হামলা থেকে সরে এলেও গোপনে গোপনে সংগঠিত হচ্ছে। যেকোনও সময় তারা আবার আগের রূপে ফিরে আসতে পারে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল এক পুলিশ কর্মকর্তা।

মানবাধিকারকর্মী ও হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি’র উপদেষ্টা নুর খান লিটন বলেন, হোলি আর্টিজান হামলার পর আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে দেশে গণতান্ত্রিক আবহ, জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব না হলে যেকোনও সময় তা আবারও বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

দীর্ঘদিন জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, গ্রেফতারের পর জঙ্গিদের যেখানে রাখা হয় সেই কারাগারের লোকজনই তো এ বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষিত নন। তাদের সমাজের মূল স্রোতে আনার তৎপরতা একেবারেই অনুপস্থিত। কারাগারগুলোতে যেভাবে নজরদারি এবং ব্যবস্থাপনা করা দরকার সে ধরনের চিত্র দেখা যায় না। প্রায়ই শোনা যায়, কারাগারে থেকেও জঙ্গিরা সক্রিয়। এভাবে চলতে থাকলে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

/আরআইজে/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ঘিরে রাখা সেই ভবন থেকে তিনটি বোমা উদ্ধার
মৎস্য খামারের আড়ালে জঙ্গি প্রশিক্ষণ, নারী সদস্য গ্রেফতার
অভিযান চলছে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে রাখা সেই ভবনে
সর্বশেষ খবর
শান্তর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়: পাপন
শান্তর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়: পাপন
এবার থানায় ঢুকলো রাসেলস ভাইপার
এবার থানায় ঢুকলো রাসেলস ভাইপার
আইনের দুর্বলতাই তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রধান বাধা
আইনের দুর্বলতাই তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রধান বাধা
নীড়ের আরও একটি সাফল্য
নীড়ের আরও একটি সাফল্য
সর্বাধিক পঠিত
‘চুপ, একদম গুলি করে দেবো’
‘চুপ, একদম গুলি করে দেবো’
সাদা ভাত খাওয়া নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো জেনে নিন
সাদা ভাত খাওয়া নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো জেনে নিন
সকালে ঢেঁড়স ভেজানো পানি খেলে মিলবে এই ৫ উপকারিতা
সকালে ঢেঁড়স ভেজানো পানি খেলে মিলবে এই ৫ উপকারিতা
এনবিআরে মতিউরদের সংখ্যা কত?
এনবিআরে মতিউরদের সংখ্যা কত?
নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়নের ধাপ দেখানো হবে ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে
নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়নের ধাপ দেখানো হবে ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে