নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোরবানির বর্জ্য দ্রুত সরিয়ে নিয়ে দৃষ্টান্ত রেখেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ঈদের আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আওতাধীন সব ওয়ার্ড থেকে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের ঘোষণা দেন। অন্যদিকে, এমন ঘোষণার পরপরই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ঘোষণা দেন, মাত্র ৬ ঘণ্টায় আওতাধীন সব এলাকা থেকে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ করবেন। কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ নিয়ে রীতিমতো এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল দুই সিটি করপোরেশনের মাঝে।
দুই মেয়রের এমন ঘোষণার পর নগরীর অনেক বাসিন্দা একে ‘ফাঁকা আওয়াজ’ বলেছেন। বিশেষ করে উত্তর সিটি মেয়রের ঘোষণার পরপর নগরীর অনেক বাসিন্দা একে ‘বাড়াবাড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নগরবাসীর এমন ভাবনার অবশ্য বহু কারণ ছিল। কিন্তু দিনশেষে নগরবাসীর জল্পনা-কল্পনা কাটিয়ে ঘোষণাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে দেখিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
বর্জ্য অপসারণে দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে কে এগিয়ে—এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মাঝে। তবে আপাতত এই প্রশ্ন প্রাধান্য না পেলেও দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যকার প্রতিযোগিতায় যে নগরবাসী সুফল পেয়েছেন তা হলফ করে বলা যায়। পশুর বর্জ্য দ্রুত সরিয়ে নিয়ে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। কোরবানির পরদিনই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা নগরীতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন নগরবাসী।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দ্রুত বর্জ্য অপসারণ বিষয়ে পুরান ঢাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তারা জানান, একসময় কোরবানির পশুর বর্জ্যের গন্ধে বাসা থেকে বের হওয়া কষ্টসাধ্য ছিল। কোরবানি দেওয়ার সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এলাকা থেকে বর্জ্যের গন্ধ পাওয়া যেতো। বর্জ্যের বাজে গন্ধে বমি আসতো। নাক চেপে হাঁটতে হতো। কিন্তু এবারের বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা ছিল প্রশংসা করার মতো।
পুরান ঢাকার ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বশির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার পুরো এলাকা পরিষ্কার। আশপাশে বর্জ্যের কোনও চিহ্ন নেই, গন্ধটাও নেই। অথচ একসময় কোরবানির পশুর এই বর্জ্য দিনের পর দিন অলিগলিতে পড়ে থাকতো। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া যেতো না। নাক চেপে ধরে হাঁটতে হতো। কিন্তু এবার সব তাড়াতাড়ি সাফ করা হয়েছে।
পুরান ঢাকার ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আজমির হোসেন। বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও হাটের বর্জ্য নিয়ে অসন্তোষের কথা জানান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ধোলাইখাল ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন যে পশুর হাট ছিল সেটার বর্জ্য এখনও শতভাগ অপসারণ হয়নি। এখনও সড়কে হাটের বর্জ্য আছে। সিটি করপোরেশনের উচিত ছিল আগে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা। পশুর বর্জ্য আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা নেই। রাতের মধ্যেই সেই বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের প্রশংসা করে পুরান ঢাকার এই বাসিন্দা বলেন, টিভিতে মেয়রের বর্জ্য অপসারণের ঘোষণা শুনেছি। প্রথমে এটাকে অতটা আমলে নেয়নি। কারণ এমন অনেক ঘোষণা এবং আশার বাণী শুনেছি, যার সত্যিকার অর্থে কোনও প্রতিফলন ঘটেনি। এই যেমন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা, সেটা তো ঘোষণাতেই আটকে আছে। বাস্তবে রূপ নেয়নি। কিন্তু এবার সিটি করপোরেশন যা করে দেখিয়েছে তা সত্যিই চমৎকার।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মহসীন তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মাত্র ছয় ঘণ্টার মধ্যে পুরো শহর থেকে কোরবানির বর্জ্য পরিষ্কার করা তো সোজা কথা নয়। আধুনিক যন্ত্রপাতি, পর্যাপ্ত লোকবল, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়ের যে বিষয়—সব মিলিয়ে অসাধারণ কাজ করেছে উত্তর সিটি করপোরেশন। উত্তরের মেয়র দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি শুধু কথায় নয় কাজেও পারদর্শী। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশন এখন ক্রমান্বয়ে আরও স্মার্ট হচ্ছে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের আরেক বাসিন্দা নুহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি ডিএসসিসির ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। বাবার চাকরির সুবাদে ১৮ বছর ধরে আমার রাজধানীতে বসবাস। এই এলাকায় আছি প্রায় এক যুগ। এর আগে মিরপুর থানা ও বাড্ডা থানা সংলগ্ন এলাকায় ছিলাম। আমাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলায়। আগে গ্রামে গিয়ে কোরবানি দিতাম। ঈদ শেষে ৭/৮ দিন পর ঢাকায় ফিরতাম। তার অন্যতম কারণ ছিল তখন কোরবানির পশুর বর্জ্য রাস্তার আশপাশে, অলিগলিতে পড়ে থাকতো। সেগুলো পচে দুর্গন্ধ ছড়াতো।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই অবস্থার এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন আর এত লম্বা সময় ধরে বর্জ্য পড়ে থাকে না। গত কয়েক বছর ধরে খুব দ্রুত বর্জ্য অপসারণ করা হয়। এবার উত্তর সিটি করপোরেশন অবাক করেছে। প্রত্যাশা করি, বর্জ্য অপসারণের মত সব কাজ সিটি করপোরেশন বিদ্যুৎগতিতে করুক।
এদিকে ঈদের দ্বিতীয় দিনের কোরবানির পশুর বর্জ্যও নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অপসারণ করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রথম দিন নির্দিষ্ট সময়ে (৬ ঘণ্টা) ডিএনসিসি এলাকা থেকে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ করা হলেও দ্বিতীয় দিনে মাত্র অর্ধেক সময় অর্থাৎ তিন ঘণ্টায় শতভাগ বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। ঈদের দিন ডিএনসিসি ১৪ হাজার ৩৭৪ মেট্রিক টন বর্জ্য অপসারণ করেছে এবং দ্বিতীয় দিনে ৪ হাজার ৯ মেট্রিক টন বর্জ্য অপসারণ করেছে। গত দুই দিনে মোট ১৪ হাজার ৩৮৩ মেট্রিক টন বর্জ্য অপসারণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনায় সাফল্য অর্জন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। দক্ষিণ সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, ২৪ ঘণ্টায় কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের কথা থাকলেও আমরা মাত্র ১০ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে সেই লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। দ্বিতীয় দিনে ৮ ঘণ্টার আগেই ডিএসসিসির সব ওয়ার্ড থেকে শতভাগ বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। দুই দিনে প্রায় ৩১ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য অপসারণ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
নির্দিষ্ট সময়ে বর্জ্য অপসারণের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, সবার সহযোগিতায় পূর্ব ঘোষিত ছয় ঘণ্টায় ঢাকা উত্তর সিটির কোরবানির বর্জ্য শতভাগ অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে। সচেতন নাগরিকদের আন্তরিক সহযোগিতায় এটি করতে পেরেছি। আমি নগরবাসীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আগামী দিনেও ঢাকা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে জনগণ ও সিটি করপোরেশনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।'
অন্যদিকে, বর্জ্য অপসারণ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, বর্জ্য অপসারণের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞকে আমরা সেবা দেওয়ার প্রতিযোগিতায় রূপান্তরিত করতে পেরেছি। একসময় হাটের বর্জ্য অপসারণে সপ্তাহ লেগে যেতো। আমরা হাটের বর্জ্য অপসারণে আলাদা কর্মপরিকল্পনা নিয়েছি এবং সেই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছি। কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি সুন্দর নগরী উপহার দেওয়ায় কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশেষত পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ঢাকাবাসীকে ধন্যবাদ।
তবে ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডের বেশ কয়েকটি এলাকার মানুষের অভিযোগ তাদের এলাকায় শতভাগ কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ হয়নি। এর মধ্যে ডিএসসিসির ২৫, ২৭, ৩১, ৩২ এবং ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড উল্লেখযোগ্য। তবে এসব ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঈদের দিন এবং ঈদের দ্বিতীয় দিনের কোরবানির বর্জ্য শতভাগ অপসারণ করা হয়েছে। ঈদের তৃতীয় দিনেও অনেকে কোরবানি দিয়েছেন। সেই বর্জ্য এলাকায় থাকতে পারে। তাও রাতের মধ্যেই অপসারণ করার কথা জানানো হয়।