X
সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২

বেইলি রোডের ভয়াল আগুনের স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে স্বজনদের

আরমান ভূঁইয়া
৩০ মে ২০২৪, ১০:০০আপডেট : ৩০ মে ২০২৪, ১০:০০

রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডে ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে নারী-শিশুসহ প্রাণ হারান ৪৬ জন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতের এ ভয়াল ঘটনা এখনও ভুলতে পারছে না নিহতদের স্বজন, আহত ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সেই ভয়াবহ রাতের ঘটনা মনে পড়লে শরীর শিউরে ওঠে। অজান্তেই আঁতকে ওঠেন অনেকে। বুকভরা কান্না ও আহাজারি করেন কেউ কেউ।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুল তাজরিন নিকিতা (২৩) ও তার মা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা লুৎফুর নাহার করিম (৫০) সেই রাতে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে খেতে গিয়ে দুজনই মারা যান। স্ত্রী ও মেয়েকে হারিয়ে দিশেহারা গোলাম মহিউদ্দিন। বুধবার (২৯ মে) বিকালে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি আজও বিশ্বাস করতে পারি না আমার স্ত্রী-মেয়ে আমাদের মাঝে নেই। আমার একটা ছেলে নিয়ে আমি দিশেহারা হয়ে গেছি। প্রতিরাতেই তাদের জন্য কান্না করি। তাদের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকি।’

প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন কাউছার তার পরিবারকে ইতালি নিয়ে যেতে ঢাকায় এসেছিলেন। তার স্ত্রী স্বপ্না আক্তার, দুই মেয়ে সৈয়দা কাশফিয়া ও সৈয়দা নূর এবং একমাত্র ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে। সেই রাতের ভয়াল আগুনের থাবায় এক এক করে সবাই পুড়ে মারা যান। নিহত ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক কাউছারের ছোট ভাই সৈয়দ আমির হামজা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কাউসার শুধু আমার ভাই ছিলেন না, তিনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন। আমাদের ভালো-মন্দ ও অর্থনৈতিক সাপোর্টার ছিলেন। তাদের চলে যাওয়া আমরা আজও মানতে পারছি না। প্রতিদিন ভাই, ভাবি ও বাচ্চাদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই ভয়াল কথা মনে করে ঘুমের মধ্যেও আঁতকে উঠি।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণে বেইলি রোডে এত বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এত মানুষের জীবন নিভে গেছে। ঘটনার এতদিন পরেও আমাদের সঙ্গে তদন্তকারী বা রাষ্ট্রের কোনও সংস্থা যোগাযোগ করেনি। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের উপযুক্ত বিচার চাই।’

আগুনে পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজের বর্তমান অবস্থা, ছবি: নাসিরুল ইসলাম ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ মূলত রেস্টুরেন্ট ভবন হিসেবে পরিচিত ছিল। ৭ তলা এই ভবনে স্যামসাং, গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার ও ইলিয়ন নামে তিনটি শোরুম ছাড়াও প্রায় ১২টি রেস্তোরাঁ ছিল। চায়ে চুমুক, শেখ হোলিক, ওয়াফে বে, কাচ্চি ভাই, খানা’স, পিৎজা হাট, স্টিট ওভেন, জেস্টি রেস্টুরেন্ট, ফোকুস ও হাক্কা ডাকা রেস্টুরেন্ট ছাড়াও ভবনটির ছাদে অ্যাম্বোশিয়া নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। ভবনটিতে কোনও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না বলে ঘটনার পর জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। তখন প্রশ্ন উঠেছিল ভবনের অব্যবস্থাপনা ও তদারকি সংস্থার দায়িত্বহীনতা নিয়ে।

গ্রিন কোজি কটেজে আগুন পুড়ে যাওয়ার পর রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। ভবনের ম্যানেজার, কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের মালিকসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করা হলেও এখনও অধরা ভবনের মালিকসহ দায়ীরা। জানা যায়, ভবনটি আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের নির্মাণ করা। নির্মাণের পর ফ্ল্যাট মালিকদের বুঝিয়ে দিয়েছে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকে সার্বিক তত্ত্বাবধান করছিল ‘গ্রিন কোজি কটেজ স্পেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’। অথচ এখনও তাদের আইনের আওতায় না আনায় ক্ষোভ জানান অনেকে। সেই সঙ্গে সিটি করপোরেশন ও রাজউকসহ তদারকি সংশ্লিষ্ট সংস্থা দায় এড়াতে পারে না বলেও জানান তারা।

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ সেই রাতের অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু ছাড়াও আহত হয়েছেন অনেকে। নিহতদের মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী এবং ৮ জন শিশু।

এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটির ঢাকা মেট্রো (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার আনিচুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলাটি এখনও তদন্তাধীন। আমরা অনেকের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। ফায়ার সার্ভিস, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়েছে। এখনও সেসব তথ্য পাওয়া যায়নি। তদন্ত শেষ হলে বিস্তারিত জানানো যাবে।

কীভাবে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি

ফায়ার সার্ভিস ও রাজউকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের নিচতলায় ‘চায়ের চুমুক’ নামে একটি দোকান ছিল। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি সেই দোকান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার থাকায় আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। এক এক করে পুরো ভবন পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

দায় এড়াতে পারে না রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টরা

রাজধানী ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বেইলি রোডে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে অপরিকল্পিতভাবে এবং কোনও ধরনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়া কীভাবে এত খাবারের দোকান ও রেস্টুরেন্ট চলেছে, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই ভবনটি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের কোনও অনুমোদন ছিল না। অগ্নিকাণ্ডের পর এ তথ্য জানা যায়। তাহলে সংশ্লিষ্ট তদারকি সংস্থা এতদিন কী করেছিল, তারা কেন দেখভাল করেনি! এর দায় তাদেরও নিতে হবে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান নগর স্থপতি (চলতি দায়িত্ব) মোস্তাক আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির আবাসিক ও অফিসের অনুমোদন নেওয়া ছিল। রেস্টুরেন্টের কোনও অনুমোদন ছিল না। তারা আমাদের কাছ থেকে অকুপেন্সি নেয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে রেস্টুরেন্ট হওয়ার পর একবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল। এখানে রেস্টুরেন্ট করার জন্য তাদের ট্রেড লাইসেন্স ও ফায়ারের লাইসেন্স ছিল। এসব লাইসেন্স কীভাবে পায়?’

সিটি করপোরেশনের দায় অস্বীকার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মাদ ফারাবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন শুধু ট্রেড লাইসেন্সের বিষয় দেখে থাকে। লাইসেন্স নেওয়া ও নবায়নের কিছু শর্ত আছে। আমরা সেগুলো দেখে থাকি। এ ধরনের ঘটনার জন্য ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও পরিবেশ অধিদফতর দায়ী। এটা তাদের দেখভালের বিষয়, সিটি করপোরেশনের না।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের ঘটনায় তাদেরও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট সবাইকেই দায় নিতে হবে। কেননা, যথাসময়ে সংশ্লিষ্ট সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করলে হয়তো এত বড় ঘটনা ঘটতো না।’

বেইলি রোডে আগুনে পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ, ছবি: নাসিরুল ইসলাম দায় এড়ানোর চেষ্টা আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের

গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগার পর ভবনটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ভবনটির সার্বিক তত্ত্বাবধান করছিল ‘গ্রিন কোজি কটেজ স্পেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। বিল্ডিংয়ের মালিক আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ নয়। শুধু জয়েন্ট ভেঞ্চারে নির্মাণকাজটি (ডেভেলপার হিসেবে) আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ সম্পন্ন করেছে। ২০১৫ সালে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হলে মালিকানাও হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে ভবনটির কার্যক্রম পরিচালনাসহ সার্বিক তত্ত্বাবধান করছে গ্রিন কোজি কটেজ স্পেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।’

 গ্রিন কোজি কটেজ শপিং মলের বর্তমান অবস্থা

বুধবার (২৯ মে) সরেজমিন দেখা যায়, আগুনে ক্ষতবিক্ষত একটি পোড়া ভবন দাঁড়িয়ে আছে বেইলি রোডের মাঝখানে। মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভবনে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ভবনের সামনে কাঁটাতারের ব্যারিকেড এবং পুলিশের কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। ঘটনার তিন মাস পরও পোড়া ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন পথচারী আক্ষেপ ও তদারককারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি জানান, দেশের বেশিরভাগ মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই কোনও একটা জায়গাও নিয়মনীতির মধ্যে চলে না। কোজি কটেজ যার অন্যতম উদাহরণ। একই কথা বলেন স্থানীয় বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অগ্নিনিরাপত্তা ও রেস্টুরেন্টের অনুমতি ছাড়া আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবন কীভাবে চলে। সিটি করপোরেশন, রাজউক, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করলে এত বড় দুর্ঘটনা দেখতে হতো না।

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

/এপিএইচ/এমওএফ/
টাইমলাইন: আগুনের ক্ষত সারলো কতটা
সম্পর্কিত
পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ক্র্যাপ শেডে আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি
গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যু
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন
সর্বশেষ খবর
দূষণরোধী অভিযান: ২৫ কোটি টাকা জরিমানা, ৬৭০ ইটভাটা বন্ধ
দূষণরোধী অভিযান: ২৫ কোটি টাকা জরিমানা, ৬৭০ ইটভাটা বন্ধ
জসিম আহমেদের উদ্যোগে বাংলায় কোরিয়ান সুপারহিট সিরিজ
জসিম আহমেদের উদ্যোগে বাংলায় কোরিয়ান সুপারহিট সিরিজ
স্টারলিংকের লাইসেন্স অনুমোদন দিলেন প্রধান উপদেষ্টা
স্টারলিংকের লাইসেন্স অনুমোদন দিলেন প্রধান উপদেষ্টা
পান্তকে এবার ২৪ লাখ রুপি জরিমানা
পান্তকে এবার ২৪ লাখ রুপি জরিমানা
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
রিজার্ভ আরও বাড়লো
রিজার্ভ আরও বাড়লো
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
ইউআইইউ বন্ধ ঘোষণা
ইউআইইউ বন্ধ ঘোষণা
প্রশাসনে অস্থিরতা কাটছেই না, বাড়ছে ক্ষোভ-অসন্তোষ
প্রশাসনে অস্থিরতা কাটছেই না, বাড়ছে ক্ষোভ-অসন্তোষ