মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন লাগে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ভোর পৌনে ৪টার দিকে। ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট প্রায় ৬ ঘণ্টা চেষ্টা করে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে মার্কেটের ‘খ’ ও ‘গ’ ব্লকের চার শতাধিক দোকান পুড়ে যায়। আগুন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার অভিযানে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং বিজিবির সদস্যদের যোগ দিতে হয়।
ঘটনার পর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে কোনও ফায়ার সেফটি ছিল না বলে জানিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, মার্কেটের কোনও ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থাই ছিল না। ছিল না পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। এ ছাড়া মার্কেটের সামনের ফুটপাত ও সড়কজুড়ে ছিল অসংখ্য দোকানপাট। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, আগুনে কৃষি মার্কেটের দুটি ব্লকের সব দোকান পুড়ে যায়। এই দুই ব্লকে মুদি, স্টেশনারি, চিকেন পণ্য, কাপড় ও গয়নার দোকান ছিল। এতে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মার্কেটের ‘ক’ ব্লক এখনও পুরনো রূপেই আছে। এ অংশে মাছ-মাংস ও সবজি বিক্রি হচ্ছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া ‘খ’ ও ‘গ’ ব্লকে নতুন ভবন নির্মাণকাজ চলছে। মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ থাকলেও কয়েকজন ব্যবসায়ী মার্কেটের ফুটপাত ও খালি জায়গায় পসরা সাজিয়ে বসেছেন।
সেই রাতের ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতিচারণা করেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। আজও তারা জানেন না কেন আগুন লেগেছিল।
মার্কেটের উত্তর গেটের সামনে মাটির তৈজসপত্র বিক্রি করেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মাদ। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা মার্কেটের পাশেই। ওই দিন ভোর রাতে আগুনের কথা শুনে দ্রুত মার্কেটের সামনে এসে দেখি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো মার্কেটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মার্কেটের গেট বন্ধ থাকায় আমাদের কোনও মালামাল বের করতে পারি নাই।’
নুর মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘কেন আগুন লেগেছিল আমরা জানি না। তবে আমাদের ব্যবসায়ী মালিক সমিতির মাধ্যমে পুড়ে যাওয়া মার্কেটের অংশে নতুন করে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।’
আরেক ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ বলেন, ‘আগুনে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী পথে বসে গেছে। এই ক্ষতি কখনও পুষিয়ে ওঠা যাবে কিনা জানে না কেউ।’
কৃষি মার্কেটের পোড়া জায়গায় এখন নতুন ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। মার্কেটের ‘খ’ ও ‘গ’ ব্লকে দুটি ভবন হচ্ছে। দুই ভবনের মাঝে প্রায় ২০ ফুট প্রশস্ত সড়ক বা ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে। মার্কেট ব্যবসায়ী মালিক সমিতির তত্ত্বাবধানে এ নির্মাণকাজ চলছে। গত বছর আগুন লাগার দুই মাস পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম নতুন মার্কেটের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন।
তবে এই মার্কেটের অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা কতটা থাকছে, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। নতুন ভবন বা মার্কেটের নকশায় কতটা অগ্নিপ্রতিরোধী ব্যবস্থা থাকছে, অবৈধভাবে মার্কেটের ফুটপাত ও সড়ক দখলমুক্ত থাকবে কিনা এসব নিয়ে সংশয়ে ব্যবসায়ীরা।
অভিযোগ রয়েছে, কৃষি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের আগে ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলু মার্কেট ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের ব্যাপারে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে তা বাস্তবায়ন হয়নি। আর এ কারণে অনেক ব্যবসায়ীর মধ্যে সংশয় রয়েছে যে কোনও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মার্কেটে আগুন লাগানো হয়েছিল কিনা!
বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে কৃষি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল বলে দাবি করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা (উত্তর) উপসহকারী পরিচালক মো. তানহারুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কৃষি মার্কেটে কোনও অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা ছিল না। ইলেকট্রিক লাইন ও সরঞ্জাম ছিল অনেক পুরনো। মার্কেটজুড়ে নকশাবহির্ভূত দোকানপাটে ভরা ছিল। ফলে ওই সময় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছিল।’
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের পর কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে তদন্ত করা হয়েছিল। মূলত কৃষি মার্কেটের আগুনের সূত্রপাত একটি দোকানের বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে।’
নির্মাণাধীন মার্কেটের প্রধান প্রকৌশলী রাশেদুজ্জামান উজ্জল বলেন, “মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের নির্মাণাধীন নতুন ভবনের ‘খ’ ও ‘গ’ ব্লক প্রায় চার হাজার স্কয়ার ফুট হবে। এর মধ্যে তিন হাজার স্কয়ার ফুটের ছাদ ঢালাই হয়েছে। মার্কেট কমিটির অর্থায়ন ও তাদের তদারকির মাধ্যমে নির্মাণকাজ চলছে।” ঈদুল আজহার আগে নির্মাণকাজ শেষ করার নির্দেশ রয়েছে বলে জানান তিনি।
নির্মাণাধীন মার্কেটের অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা কতটা থাকছে, এমন প্রশ্নে রাশেদুজ্জামান উজ্জল বলেন, ‘ভবনের নকশা ও নির্মাণে সিটি করপোরেশন তত্ত্বাবধায়নে রয়েছে। মার্কেটের বেজমেন্টে এক লাখ লিটারের একটি পানির রিজার্ভ থাকছে। এতে শুধু কৃষি মার্কেট নয়, আশপাশের অন্য কোনও মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে এখান থেকে পানি সরবরাহ করা যাবে।’
কৃষি মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ সলু বলেন, ‘আগুন লাগার পর মার্কেট পুনর্নির্মাণে ত্রাণ মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন থেকে প্রায় ছয় কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছিল। ওই টাকা ও ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীরা কোনও টাকা না দেওয়ায় নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।’