দীর্ঘ ২৫ বছর বিচার শেষে গত ৯ মে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। রায়ে বিতর্কিত ও আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তিন জনকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আদালত। ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল সোহেল চৌধুরীকে।
অন্যদিকে চিত্রনায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ওরফে ইমন ওরফে সালমান শাহ মারা যান ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। এই দুই জনপ্রিয় নায়কের মৃত্যুর ঘটনায় চলচ্চিত্রশিল্পে যেমন ঘোর অমানিশা নেমে আসে, তেমনই সালমান শাহ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকায় তার ভক্তকুল আজও ভুলতে পারেননি তাকে এবং মেনে নিতে পারেননি তার মৃত্যুকে।
রাজধানীর নিউ ইস্কাটন রোডের ১১/বি ইস্কাটন প্লাজার ফ্ল্যাট থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শুরু থেকে তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য থেকেই যায়। কিন্তু ২৭ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত পরিবার জানতে পারেনি সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে?
‘আত্মহত্যা’য় জোর তদন্ত সংস্থাগুলোর
সালমান শাহর মা-বাবা ও নিকটজনদের অভিযোগ, সালমানকে হত্যা করা হয়েছে। তার মৃত্যুর নেপথ্যেও সেই আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে দায়ী করে আসছেন স্বজনরা। একই সঙ্গে চিত্রনায়িকা কাজী শারমিন নাহিদ নূপুর ওরফে শাবনুর ও স্ত্রী সামিরা হকের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও পারিবারিক কলহের কারণে সালমান শাহ ‘আত্মহত্যা’ করেছেন বলে তদন্ত সংস্থাগুলোর অভিমত।
২৭ বছর অপেক্ষায় মা
সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন, এমন তথ্য কোনোভাবেই মানতে নারাজ তার মা নিলুফার জামান চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরী। মাত্র ২৫ বছর বয়সে সন্তানের রহস্যময় মৃত্যুর বিচার দেখতে ২৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় আছেন তিনি। বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত ও প্রতিবেদনের পরও সন্তুষ্ট হতে না পেরে তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রিভিউ শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এ মামলার বিচার শুরু হবে নাকি তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করে দেওয়া হবে?
যা বললেন আইনজীবী
সালমান শাহর মৃত্যুর পর ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রমনা থানায় একটি এজাহার দাখিল করেন সালমান শাহর বাবা কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। পুলিশ সেটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করেছিল। ২০০০ সালের ১১ মে তিনি মারা গেলে তার স্ত্রী অর্থাৎ সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী মামলার তদারকি করে আসছেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি বেশির ভাগ সময় যুক্তরাজ্যে অবস্থান করেন। তার পক্ষে পুরো মামলা দেখভাল করছেন আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ।
ততদিনে পচে গেছে লাশ
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. তেজেন্দ্র চন্দ্র দাস প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে সালমান শাহর মৃত্যুকে আত্মহত্যাজনিত বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু স্বজনদের আপত্তির কারণে আদালতের নির্দেশে ১৯৯৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. নার্গিস আরা চৌধুরী। ১৯৯৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি চূড়ান্ত মতামত দেন। মতামতে তিনি সালমান শাহর মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, তত দিনে সালমান শাহর শরীর পুরোপুরি পচে গিয়েছিল। পরে প্রতিবেদনটি স্থগিত রাখা হয়।
সালমান শাহর মৃত্যুর পর জব্দ করা ৪৭টি আলামতের কোনোটিতেই কোনও ধরনের রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়নি বলে ভিসেরা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তার মৃত্যুর আসল কারণ চিহ্নিত করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। তারা প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেওয়া মতামতে বলেছেন, ‘এই মৃত্যু স্পষ্টতই আত্মহত্যাজনিত।’
চিত্রনায়ক সালমান শাহর মৃত্যুর মামলাটি তদন্ত করে পুলিশের চারটি সংস্থা। প্রতিটি সংস্থার প্রতিবেদনেই সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করেন। জুডিসিয়াল তদন্তেও বলা হয়েছে আত্মহত্যার বিষয়টি।
তদন্তে আস্থা র্যাবে
চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি সালমান শাহর মায়ের পক্ষে পরিচালনা করছেন অ্যাডভোকেট ফারুক আহাম্মদ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, পিবিআইয়ের তদন্তে অনাস্থা দিয়ে ইতোমধ্যে আদালতে পুনরায় শুনানির জন্য আবেদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সালমান শাহ আত্মহত্যা করেননি। এটি একটি হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আছেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তার সহযোগীরা। সেটা প্রমাণে সব ধরনের আইনি লড়াই চালিয়ে যাবো। আমরা চাই নতুন কোনও তদন্ত সংস্থাকে দিয়ে মামলাটি তদন্ত করাতে। এ ক্ষেত্রে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) দিয়েই তদন্ত করাতে চাই।
অঅরও পড়ুন:
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন