X
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাঁধে ঋণের বোঝা

আতিক হাসান শুভ
২৭ মার্চ ২০২৪, ১০:০০আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৪, ১০:০০

বিভিন্ন মার্কেটে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষণিক কিছু সাহায্য পেলেও ভবিষ্যতে তারা কোন অবস্থায় দাঁড়াবে বা এখন কী অবস্থা চলছে, কেমন কাটছে তাদের দিনকাল, সেই খবর কেউ রাখে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগই ব্যাংক, সমিতি ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করছিলেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগুনে সব হারিয়ে এখন তাদের কাঁধে ঋণের বোঝা চেপেছে। ঋণের বোঝা থেকে কীভাবে মুক্তি পাবেন—তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা।

গত বছর বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ২০ জন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা এখন পর্যন্ত ফের ব্যবসা শুরু করার মতো কোনও সহযোগিতা পাননি। তবে তাদের কর্মচারীরা এবং অল্প সংখ্যক ছোট ব্যবসায়ী সামান্য কিছু টাকা তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেছেন, এক বছর পার হয়ে যাচ্ছে, আমরা এখনও কোনও সহযোগিতা পাইনি। শুনেছি জেলা প্রশাসক এবং প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য টাকা দিয়েছে। সেই টাকাও আমরা পাইনি। পরিবার চালাতে আমরা এখন হিমশিম খাচ্ছি। একেকজনের কাঁধে এখন ২৫-৩০ লাখ টাকার ওপরে ঋণ। কারও ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। এখন বঙ্গবাজারে আমরা যারা ব্যবসা করছি, তাদের সবার কাঁধেই ঋণের বোঝা।

বঙ্গবাজারে আগুন, ছবি: নাসিরুল ইসলাম আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী দোলন গার্মেন্টসের মালিক মো. মুহিন বলেন, ‘আমার ২১৮৫-৮৬-৮৭ এই তিনটি দোকান পুড়েছে। এতে এক কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ওই সময় আমার কাঁচাবাজার করারও টাকা ছিল না। তখন যদি ২০-৫০ হাজার টাকাও পেতাম, সেটা আমাদের অনেক উপকারে আসতো।’ নতুন করে ব্যবসা শুরুর বিষয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘ঘর-সংসার যেহেতু আছে, ব্যবসা তো শুরু করতেই হবে। পরিচিত যারা ছিলেন, তাদের কাছ থেকে বাকিতে মালামাল এনে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছি।’

মুহিন বলেন, ‘আমি এখন ঋণের সাগরে ডুবে আছি। প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো ঋণ আছে। কয়দিন পরপরই পাওনাদার টাকা চেয়ে বসে। এখন নয় পরে দেবো, এ সপ্তাহে না আগামী সপ্তাহে দেবো, এ মাসে না আগামী মাসে দেবো—এ রকম বলে এখনও টিকে আছি। ব্যাংকের ঋণও প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো। যা ইনকাম করি, সেটা দিয়ে কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এই ঋণের বোঝায় পাগল হয়ে যাচ্ছি। মন চাচ্ছে আত্মহত্যা করতে।’

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের রাবেয়া গার্মেন্টসের মালিক মো. মানিক খাঁন, তিশা গার্মেন্টসের মালিক মো. আনোয়ার হোসেন, মায়ের দোয়া গার্মেন্টসের শিমুল, বিসমিল্লাহ গার্মেন্টসের খোরশেদসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কেউ কোনও সহযোগিতা পাননি। সবাই এখন ঋণে জর্জরিত। ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত তারা।

তিশা গার্মেন্টসের মালিক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসার সুবাদে কমবেশি সবার সঙ্গে বাকিতে লেনদেন হতো। আগুনে পুড়ে যখন সর্বনাশ হলো, তখন টুকটাক অনেকের দেনা ঋণ করে পরিশোধ করেছি। এখনও ৩০ লাখ টাকার ওপরে ঋণ আছে। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না, কী করে এই ঋণ পরিশোধ করবো।’ কোনও সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একটা কানাকড়িও পাইনি।’

আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার, ছবি: নাসিরুল ইসলাম হারুন অর রশিদ নামে আরেকজন ভুক্তভোগী বলেন, ‘আগুনে পোড়ার তিন বছর আগে ফসলি জমি বিক্রি করে সেই টাকা ব্যবসায় খাটিয়েছি। কিন্তু আগুনে আমার সর্বনাশ হয়ে গেলো। এখন পরিচিতদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করেছি। এই মুহূর্তে আমি ১০ লাখ টাকার মতো ঋণগ্রস্ত। এই ঋণ কতদিন কাঁধে নিয়ে চলতে হয় জানা নেই। ব্যবসা যদি ভালো হতো, তাহলে আর চিন্তা থাকতো না।’

এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর থেকে এই মার্কেটের বেচাকেনা কমে গেছে। আগে প্রতিদিন যে হারে পাইকারি বিক্রি হতো, এখন তার চার ভাগের এক ভাগও বিক্রি হয় না। খুচরা বিক্রিও অনেক কমে গেছে। আগে যে ক্রেতা পাইকারি দামে দুই লাখ টাকার মালামাল নিতেন, এখন তিনি ৫০ হাজার টাকার মাল নেন। আমরাও কোনোরকমে কাস্টমার ধরে রেখেছি। কারণ, ব্যবসা ছাড়া আমাদের আর কোনও গতি নেই।’

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আরেকজন এন এম সিল্ক হাউজের মালিক মো. নুরুন্নবী। তিনি বলেন, ‘আমার তিনটি দোকানে সাড়ে চার কোটি টাকার মাল ছিল। ব্যাংকের ঋণ, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে আনা ধার বাবদ ৯০ লাখ টাকার ওপরে ঋণ এখন আমার কাঁধে। ব্যবসা আবার স্টার্ট করেছি, কিন্তু ঋণে জর্জরিত। যাদের কাছ থেকে ধার নিয়েছি, তারা এরইমধ্যে টাকা চাইতে শুরু করেছেন। জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আগে রমজান এলে  দুই হাতে দান করতাম। এখন রমজানে দুই হাতে ভিক্ষা করার উপক্রম। ভেবে পাচ্ছি না কী করে ঋণ শোধ করবো। ছেলেমেয়ে না থাকলে একদিকে উধাও হয়ে যেতাম।’ সরকারি কোনও সহযোগিতা না পাওয়ার কথা জানান তিনি।

আগুনে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তূপ, ছবি: নাসিরুল ইসলাম জানা গেছে, মালিকরা কোনও  সহযোগিতা না পেলেও দোকানের কর্মচারীরা কিছু আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। বঙ্গবাজার পুড়ে যাওয়ার সময় একটি গার্মেন্টস দোকানের কর্মচারী ছিলেন সাব্বির। তিনি বলেন,  ‘আমি ২০  হাজার টাকা পেয়েছি। আমার মতো এমন অনেকে পেয়েছেন। তবে মালিকরা পেয়েছেন কিনা সেটা বলতে পারবো না।’

তবে আরেক কর্মচারী বলেন, আমার মালিকের ২ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। সেখানে আমি ২০-২৫ হাজার টাকা নিয়ে কী করবো। ভেবেছিলাম আগুনের পর হয়তো বেতন পাবো না। কিন্তু মালিক ঠিকই আমাকে বেতন দিয়েছেন। দোকান মালিকদের সহায়তার বিষয়ে এই কর্মচারী বলেন, যেই মালিকের একসঙ্গে দুই-আড়াই কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তাকে ২০-২৫ হাজার টাকা ভিক্ষা দেওয়ার কোনও মানে আছে? যে দোকান মালিক মাসে এক লাখ টাকা দোকানের কর্মচারীদের বেতন দেন, তিনি কি ২০ হাজার টাকার জন্য লাইনে দাঁড়াবেন!

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সরকারি সহায়তার বিষয়ে বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম জহির বলেন, ‘জেলা প্রশাসক যে ৯ কোটি টাকা দিয়েছেন, সেটা শুধু কর্মচারীদের জন্য ছিল, দোকান মালিকের জন্য ছিল না। তবে কর্মচারীরাও সেই টাকা ঠিকমতো বুঝে পাননি। অনেক বহিরাগত সেই টাকার ভাগ নিয়েছে। জেলা প্রশাসক ঢালাওভাবে পরিচয় চিহ্নিত না করেই টাকা দিয়েছেন। এ বিষয়ে আমরা মেয়র সাহেবকেও অভিযোগ জানিয়েছি।’ ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ১৫ কোটি টাকা এ সপ্তাহের ভেতরেই বণ্টন করা হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া সমিতির ফান্ডে ক্ষতিপূরণ বাবদ আরও ৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা আছে। মোট ২১ কোটি ১৩ লাখ টাকা আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ২৯৬১ জন ব্যবসায়ীর মাঝে বণ্টন করে দেবো।’

আরও পড়ুন:

আধুনিক হচ্ছে মিরপুর, কিন্তু ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা কেমন?

 মার্কেট ঘিরে অবৈধ দোকানপাটে বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি

/এপিএইচ/এমওএফ/
টাইমলাইন: বঙ্গবাজারে আগুন
২৭ মার্চ ২০২৪, ১০:০০
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাঁধে ঋণের বোঝা
০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০৫
০৫ এপ্রিল ২০২৩, ২৩:০০
০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:১৯
সম্পর্কিত
পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ক্র্যাপ শেডে আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি
গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যু
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন
সর্বশেষ খবর
ইউআইইউ’র সমাধান কোন পথে?
ইউআইইউ’র সমাধান কোন পথে?
সিলেটে ঘরের দরজা ভেঙে মামা-ভাগনের লাশ উদ্ধার
সিলেটে ঘরের দরজা ভেঙে মামা-ভাগনের লাশ উদ্ধার
ইউনাইটেড পাওয়ারের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন, বিদ্যুৎ না থাকায় ডিইপিজেডে উৎপাদন বন্ধ
ইউনাইটেড পাওয়ারের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন, বিদ্যুৎ না থাকায় ডিইপিজেডে উৎপাদন বন্ধ
বৈভবের রেকর্ড গড়া ম্যাচে গুজরাটকে উড়িয়ে দিলো রাজস্থান
বৈভবের রেকর্ড গড়া ম্যাচে গুজরাটকে উড়িয়ে দিলো রাজস্থান
সর্বাধিক পঠিত
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
ইউআইইউ বন্ধ ঘোষণা
ইউআইইউ বন্ধ ঘোষণা
প্রশাসনে অস্থিরতা কাটছেই না, বাড়ছে ক্ষোভ-অসন্তোষ
প্রশাসনে অস্থিরতা কাটছেই না, বাড়ছে ক্ষোভ-অসন্তোষ
মানবিক করিডোরের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে সরকার
মানবিক করিডোরের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে সরকার
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু