X
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২

মালিক সমিতির লাভের আশায় নতুন ভবন হয়নি বঙ্গবাজারে

জুবায়ের আহমেদ
১১ এপ্রিল ২০২৩, ২২:০১আপডেট : ০১ মে ২০২৩, ১৭:৪৪

১৯৮৮ সালে গুলিস্থান ট্রেড সেন্টার আর সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হয়। তখন ওই জায়গার ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে দোকান করে দেওয়া হয়েছিল। সেই স্থানটিই হচ্ছে বঙ্গবাজার; গত ৪ এপ্রিল ভোরে অগ্নিকাণ্ডে যে মার্কেট পুড়ে ছাই হয়ে মিশে গেছে মাটিতে।

মার্কেটের সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বঙ্গবাজার মার্কেট প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দোকানমালিকরা মার্কেটটিকে বহুতল ভবনে রূপ দেওয়ার বিষয়ে অনীহা দেখিয়েছেন। এর পেছনে রয়েছে মালিকদের অত্যধিক লাভের আশা। আর এতে ভূমিকা রেখেছে যখন যে সরকার, সেই সরকারের অনুসারীরা। বারবার দায়িত্ব পেয়েও ভবন নির্মাণের বিষয়টি এড়িয়ে গেছে মালিক সমিতি।

মালিক সমিতির সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গবাজার মার্কেটের মোট আয়তন ২১ হাজার ২৫০ বর্গফুট বা ১ দশমিক ৬৯৭ একর বা ১০২ কাঠা (প্রায়)। মার্কেটটিতে ছিল মোট ২ হাজার ৯৬১টি দোকান।

ভাঙা হচ্ছে আশপাশের পুরনো ক্ষতিগ্রস্ত ভবন

যেভাবে গড়ে ওঠে বঙ্গবাজার
বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, ১৯৮৮ গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার আর সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেট ভেঙে নতুন মার্কেট তৈরি করা হয়। সে সময় ওই স্থানের ব্যবসায়ীদের বর্তমান বঙ্গবাজারে অস্থায়ীভাবে দোকান করে দেওয়া হয়। পরে ভবন দুটির নির্মাণ শেষ হলেও অনেক ব্যবসায়ী সেখানে চলে যান। ফলে এই অস্থায়ী মার্কেট ফাঁকা হয়ে যায়। এ অবস্থায় তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ২০ হাজার টাকায় ব্যবসায়ীদের দোকানগুলো বরাদ্দ দেন। পরে দোকান মালিক সমিতি দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা নিজ অর্থায়নে নির্মাণ করে।

এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ গার্মেন্টসের মালিক মো. সাইয়িদ মাতবর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৩২ বছর ধরে এই মার্কেটে আছি। আমার কেনা দোকান এইখানে। ১৯৯২ সাল থেকে এইখানে অন্যের দোকান ভাড়া নিয়া ব্যবসা শুরু করি। পরে ২০১১ সালে সাড়ে ১৮ লাখ টাকা দিয়ে নিজে দোকান নিছি।’

সাইয়িদ আরও বলেন, ‘এই জায়গাটা আগে ফাঁকাই ছিল। পরে ১৯৮৮ এখন যেই গুলিস্তান ট্রেড সেন্টার আর সুন্দরবন স্কয়ার আছে, সেগুলা টিনশেড ছিল। ওইখানে বিল্ডিং বানানোর সময় এখানে ওই জায়গার ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে দোকান করে দেয়। পরে ওই মার্কেটগুলো চালু হলে সবাই ওইখানে চলে যায়। তখন সাদেক হোসেন খোকা এইখানের দোকানগুলো ২০ হাজার টাকায় বরাদ্দ দিয়ে যান ব্যবসায়ীদের।’

২০০৮ সালে এক আত্মীয়কে ১৯ লাখ টাকায় দুটি দোকান কিনে দিয়ে নিজেই পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন মো. সালাউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মালিক পরিবর্তন হয়েছে। আমি এক সরকারি কর্মকর্তা থেকে দোকান দুইটা কিনেছি। এর আগে আমি এই মার্কেটেই কাজ করতাম। ধীরে ধীরে এই মার্কেটের আশপাশে আরও কয়েকটা মার্কেট তৈরি হয়। পরে দোকান মালিক সমিতি ওপরের দিকে বাড়ায়। তখন আরও জমজমাট হয় এই মার্কেট।’

বঙ্গবাজার মার্কেট প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দোকানমালিকরা মার্কেটটিকে বহুতল ভবনে রূপ দেওয়ার বিষয়ে অনীহা দেখিয়েছেন

দোকানমালিকরা খাজনা দেন কাকে
বার্ষিক খাজনা, দোকান ভাড়া ও ট্রেড লাইসেন্স বাবদ সিটি করপোরেশনকে অর্থ প্রদান করেন ব্যবসায়ীরা। ট্রেড লাইসেন্স ও খাজনা বাবদ মোট ১০ হাজার টাকা দিতে হয় বলে জানান তারা। এর মাঝে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভাড়া বাবদ নেয় সারচার্জসহ ৪ হাজার ৩৮৬ টাকা।

ব্যক্তিমালিকানাধীন দোকানের ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ
মালিকানাধীন দোকানগুলো ১০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় চলতো। কোনও কোনও ব্যবসায়ী বছরের শুরুতে সারা বছরের জন্য এককালীন ৯০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে দেন। এ ছাড়া দোকানের অগ্রিম গড়ে ৫ লাখ টাকা।

দোকানপ্রতি সার্ভিস চার্জ ৫০০ টাকা (নিরাপত্তাকর্মী ও বিদ্যুৎ বিল) এ ছাড়া সমিতির পক্ষ থেকে ৩০০ টাকা নেওয়া হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

নতুন ভবনে পুরনো দোকানমালিকদের জায়গা হবে কি
সমিতির সূত্র অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত তালিকা তৈরি করে সিটি করপোরেশনকে জমা দেওয়া হয়েছে। নতুন কোনও ব্যবসায়ী নতুন ভবনে দোকান নেওয়ার সুযোগ পাবেন কি না, এমন প্রশ্নে সমিতির এক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভাড়া নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা ব্যবসায়ীদের তালিকা করে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।’

মালিক সমিতির লাভের আশায় নতুন ভবন হয়নি বঙ্গবাজারে

সরকার বদলালে কমিটি বদলায়
সরকার বদলালে বঙ্গবাজারের মার্কেটগুলোর মালিক সমিতির কমিটিও বদল হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘যখন যে সরকার আসে, সেই সরকারের লোকজন কমিটিতে আসে। আমরা শুরুতে যাদের দেখছি, তাদের অনেকেই এখন মারা গেছেন। এই কমিটিতে কোনও রীতিনীতি ছিল না; নির্বাচনও ছিল না।

ব্যবসায়ী সমিতির স্বার্থে হয়নি নতুন মার্কেট
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে নতুন মার্কেট করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বঙ্গবাজার মার্কেট সমিতি নিজেদের লাভ ও স্বার্থের কথা চিন্তা করে এখানে মার্কেট করতে দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

শাহাবুদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এখানে সিটি করপোরেশন আগে চেয়েছিল মার্কেট করবে কিন্তু কমিটির লোক তা দেয়নি। কারণ, এইখানে দোতলা পর্যন্ত আমাদের দোকান, পরের তিন তলায় গোডাউন দিয়া তারা ভাড়া খাইছে। এই জন্য এইটা মার্কেট করতে দেয় নাই।’

ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন আরও বলেন, ‘সাঈদ খোকন যখন মেয়র হন, তিনি আমাদের বলেছিলেন আপনারা এক লাখ করে টাকা দেন। তারপর আস্তে আস্তে করে টাকা জমান এখানে বিল্ডিং করবো। তিন লাখ টাকার বুকিংয়ে এক লাখ ১০ হাজার টাকা আমরা সোনালী ব্যাংকে জমা দিই। সেই কাগজপত্র আমাদের কাছে আছে।’

সমিতি নিজেদের লাভ ও স্বার্থের কথা চিন্তা করে এখানে মার্কেট করতে দেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা

যা বলছে মালিক সমিতি
ব্যবসায়ীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি এই মার্কেটের শুরু থেকে আছি। এই ধরনের অভিযোগ বারবার আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। আমি বলতে চাই, এগুলো সব মিথ্যা। অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যারা এই মার্কেটের ভালো চান না, সমিতির ভালো চান না। তারাই এইসব কথা বলে বেড়ায়।’

জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৯ সালে মেয়র সাহেব এখানে বহুতল ভবন নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তখন ব্যবসায়ীদের অনুরোধেই নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয় এবং হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। এখানে সমিতির কোনও লাভ ছিল না। তখন ব্যবসায়ীরা মনে করেছিলেন, নতুন ভবন হলে তাদের দোকান হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। নতুন দোকান নিতে গেলে আরও বেশি টাকা দিতে হবে। তা ছাড়া তাদের ভবন নির্মাণ করা পর্যন্ত কোথায় ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হবে, নানা কারণে তারাই এই ভবন নির্মাণে আগ্রহী ছিল না।’

সরকার বদলালে কমিটি বদলায় এবং সমিতির কমিটি নির্বাচনের বিষয় জানতে চাইলে এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এইখানে রাজনৈতিক কোনও ভেদাভেদ নেই। আমরা এইখানে সবাই ব্যবসায়ী, এইটাই আমাদের পরিচয়। আর সমিতিতে তিন বছর পরপর নির্বাচন হয়। তবে আমাদের নির্বাচনের পদ্ধতি ভিন্ন। বেশির ভাগ সময় কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে না, তখন সমিতির সদস্যরা হাত উত্তোলনের মাধ্যমে সমর্থন দেন প্রস্তাবিত প্রতিনিধিকে।’

/এনএআর/
টাইমলাইন: বঙ্গবাজারে আগুন
১১ এপ্রিল ২০২৩, ২২:০১
মালিক সমিতির লাভের আশায় নতুন ভবন হয়নি বঙ্গবাজারে
০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০৫
০৫ এপ্রিল ২০২৩, ২৩:০০
০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:১৯
সম্পর্কিত
আ.লীগ নিষিদ্ধ না করলে দুই উপদেষ্টাকে অপসারণে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি এনসিপির
চকবাজারে স্টোভের আগুনে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
নকশাবহির্ভূত সব রেস্তোরাঁর ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করলো ডিএসসিসি
সর্বশেষ খবর
ইউআইইউ’র সমাধান কোন পথে?
ইউআইইউ’র সমাধান কোন পথে?
সিলেটে ঘরের দরজা ভেঙে মামা-ভাগনের লাশ উদ্ধার
সিলেটে ঘরের দরজা ভেঙে মামা-ভাগনের লাশ উদ্ধার
ইউনাইটেড পাওয়ারের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন, বিদ্যুৎ না থাকায় ডিইপিজেডে উৎপাদন বন্ধ
ইউনাইটেড পাওয়ারের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন, বিদ্যুৎ না থাকায় ডিইপিজেডে উৎপাদন বন্ধ
বৈভবের রেকর্ড গড়া ম্যাচে গুজরাটকে উড়িয়ে দিলো রাজস্থান
বৈভবের রেকর্ড গড়া ম্যাচে গুজরাটকে উড়িয়ে দিলো রাজস্থান
সর্বাধিক পঠিত
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
‘আমার স্বামীর কোনও দোষ নাই, শুধু আ.লীগ করে বলে মাইরা ফেলাইছে’
ইউআইইউ বন্ধ ঘোষণা
ইউআইইউ বন্ধ ঘোষণা
প্রশাসনে অস্থিরতা কাটছেই না, বাড়ছে ক্ষোভ-অসন্তোষ
প্রশাসনে অস্থিরতা কাটছেই না, বাড়ছে ক্ষোভ-অসন্তোষ
মানবিক করিডোরের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে সরকার
মানবিক করিডোরের জন্য যেসব শর্ত দিয়েছে সরকার
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু
ধর্ষণের অভিযোগে ইমামকে গণপিটুনি, কারাগারে মৃত্যু