মোবাইল ফোন শিল্পে কোনও সুখবর নেই। শুধু বিক্রি কমছে আর কমছে। আমদানি বন্ধ, ডলার সংকটের কারণ কাঁচামালের সংকট, ফলে দেশের বাজারে মোবাইল ফোনের উপস্থিতি কমেছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা যেমন কমেছে, তেমনই সার্বিকভাবে বিক্রির পরিমাণও কমে গেছে। অপরদিকে ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। কিছু কিছু কারখানা মোবাইল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক কারখানায় উৎপাদন কমানো হয়েছে। ফলে এই শিল্পে একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সময়ে সরকার যদি গ্রাহক পর্যায়ে আরোপিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে এই বাজারটি সহনীয় পর্যায়ে আসতে পারে। ক্রেতারা তাদের প্রয়োজনীয় ফোনটি কিনতে পারেন। তারা আরও বলেন, মোবাইলফোন হাতবদল হলেই ভ্যাট আরোপ করা হয়। উৎপাদক থেকে ডিস্ট্রিবিউটর, ডিস্ট্রিবিউটর থেকে ক্রেতা পর্যন্ত গেলেই ভ্যাট দিতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের কথা বলা হলেও মোবাইলের খুচরা ক্রেতাকে ২২ শতাংশের বেশি ভ্যাট দিতে হয়।
জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গ্রাহক পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) যত সমস্যা তৈরি করেছে। এতে মোবাইলের দাম বেড়ে গেছে। মানুষ প্রয়োজন ছাড়া কোনও কেনাকাটা করছে না। মোবাইলের বেলায়ও একই ঘটনা, দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে গেছে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে কথা বলেছি। রাজস্ব বোর্ড বিষয়টা খতিয়ে দেখবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডলার সংকট, পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে না পারা, কাঁচামালের সংকট ইত্যাদি কারণে এমনিতেই মোবাইলের দাম বেড়ে গেছে। একাধিক মোবাইল কারখানায় উৎপাদন বন্ধ। ফলে এ খাতে সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘গ্রাহকের ওপর ধার্য করা ভ্যাট যদি না থাকে, তাহলে মোবাইল খাতে চলমান সব ধরনের সমস্যা দূর হয়ে যাবে।’ তিনি এ বিষয়ে আশাবাদী বলেও জানান।
মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমআইওবি) সহসভাপতি রেজওয়ানুল হক বলেন, ‘আমরা তো চাই এটা (১৫ শতাংশ) প্রত্যাহার হোক। কিন্তু চাইলেই তো আর হবে না। সবাইকে এই বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে এখন বিভিন্ন পক্ষ আছে, সবাইকে টিকে থাকতে হবে।’
তিনিও মনে করেন, ভ্যাট প্রত্যাহার হলে মোবাইলের দাম কমবে। আর এটা হলেই মোবাইল ফোন নিয়ে চলমান সব সম্যার সমাধান হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্তত দুজন আমদানিকারক ও উৎপাদক জানান, তাদের ব্যবসায় নাকি ‘শনি’ ভর করেছে। বিক্রি নামতে নামতে একবারে প্রায় শূন্যের কোঠায়। এলসি খুলতে না পারায় দীর্ঘদিন বাজারে তাদের নতুন মডেলের সেট নেই। অপরজন বলেন, ক্রেতার ফোনের চাহিদা আছে, কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা নেই। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। যার ৫০ হাজার বা লাখ টাকার মোবাইল কেনার প্রয়োজন, তাকে এগুলো কিনতে হলে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের টাকা বাদ দিয়ে কিনতে হয়। ফলে তিনি তার মনের মতো সেট কিনতে পারছেন না। অনেকে প্রয়োজন থাকলেও কিনছেন না। অপরদিকে ভ্যাটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাজারে।
মোবাইল বাজার ঘুরে অন্তত ৩টি মোবাইলের বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, স্যামসাং ও অপো ব্র্যান্ডের মোবাইল ৩০ শতাংশ এবং রিয়েলমির বিক্রি ৪০ শতাংশ কমে গেছে। অন্যান্য ব্র্যান্ডের মোবাইলের বিক্রিও কমেছে বলে তারা জানান।
দেশের একটি শীর্ষ অনলাইন মার্কেটপ্লেস তাদের সাইটের মোবাইল বিক্রির একটি চিত্র তুলে ধরেছে। যা দেখে দেশের মোবাইল ফোনের বাজারের বর্তমান চিত্র বোঝা যায়। তাদের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত আগস্ট মাসে তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে মোবাইল বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজার, সেম্টেম্বরে যা ছিল ২৪ হাজার। অক্টোবর মাসে তা কমে হয় ২০ হাজার। প্রতি মাসেই বিক্রি কমেছে। নভেম্বর মাসে মোবাইল বিক্রি হয়েছে ১৮ হাজার। ডিসেম্বরে যা ছিল ১৫ হাজার। গত জানুয়ারি মাসে যা এসে দাঁড়ায় ১২ হাজারে।
ওই মার্কেট প্লেসের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, দেশের মোবাইল বাজারের সার্বিক চিত্র আসলে এমনই। শুধু কমছে আর কমছে। তিনিও মনে করেন, অন্তত ভ্যাট ১৫ শতাংশ প্রত্যাহার করলে মোবাইলের দাম কিছুটা সহনীয় হতে পারে। তখন বিক্রি বাড়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে।