দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে স্বেচ্ছাসেবামূলক নানা সামাজিক কাজে যুক্ত হয়েছিলেন কওমি মাদ্রাসার আলেমরা। করোনায় মৃতদেহের সৎকার-দাফন, নিম্ন আয়ের মানুষদের ত্রাণ সহায়তা এবং হিজড়া-বেদেসহ পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে মানবিক সহযোগিতা দিয়েছেন তারা। তবে, গত দুই মাসে ধীরে ধীরে সেবাপ্রার্থী বেড়ে যাওয়ায় অর্থ সংকটে পড়েছেন উদ্যোক্তা আলেমরা।
স্বেচ্ছাসেবী আলেমরা বলছেন, সামাজিক কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে দেখলেন চাহিদা অনেক। সে অনুপাতে জোগান নেই। সরকারি নিবন্ধন না থাকায় তারা দেশি-বিদেশি সাহায্যও পাচ্ছেন না। পাশাপাশি মৃতদেহের সৎকার করতে গিয়ে অনেক স্বেচ্ছাসেবী আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। তবে উদ্যোক্তাদের দাবি, স্বেচ্ছাসেবকদের অসুস্থতা, আর্থিক সংকট থাকলেও তাদের কাজ থেমে থাকবে না।
লকডাউনের সময় দরিদ্রদের ত্রাণ দিয়েছেন তাকওয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা মাওলানা গাজী ইয়াকূব। এরপর করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেলে তারা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় সৎকার কার্যক্রমও শুরু করেন। তবে সরকারি স্বীকৃতি না থাকায় ঢাকায় সৎকার কার্যক্রম সীমিত করেন তিনি। এ পর্যন্ত দেশব্যাপী ছয় শতাধিক মরদেহ দাফনের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন তাকওয়া ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক আলেমরা।
সরকারি স্বীকৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে গাজী ইয়াকূব বলেন, তারা নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করেছেন। তবে এখনও কোনও ফল আসেনি।
বাংলা ট্রিবিউনকে গাজী ইয়াকূব বলেন, ‘তাকওয়া ফাউন্ডেশন ১০ এপ্রিল কার্যক্রম শুরু করে। আমি অনেকটাই নিজস্ব অর্থায়নে সহযোগিতামূলক কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর ছিন্নমূল এক হাজার মানুষকে খাবার পৌঁছে দিয়েছি। আমাদের অ্যাম্বুলেন্স সেবা রয়েছে। সিলিন্ডার সেবা রয়েছে। কিন্তু আমাদের কোনও অর্থায়ন নেই।’
তাকওয়া ফাউন্ডেশনের সরকারি নিবন্ধন নেই উল্লেখ করে গাজী ইয়াকূব বলেন, ‘সরকারের অনুমোদন থাকলে দেশি-বিদেশি সহযোগিতা পাওয়া সহজ হয়। নিবন্ধন না থাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করোনাকালীন কোনও সহযোগিতাও তাকওয়া ফাউন্ডেশন পাচ্ছে না।’
তরুণ আলেমদের সমন্বয়ে গঠিত ইকরামুল উম্মাহ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল করোনাভাইরাস আসার আরও ছয় মাস আগে। দেশে করোনা আসার পরে তাদের প্রথম কার্যক্রম শুরু হয়। নগদ অর্থ এবং বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী দিয়ে প্রায় তিন হাজার মানুষকে সহযোগিতা করেছে তারা। হিজড়া, বেদে ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাঝেও ত্রাণ দিয়েছে তারা।
ইকরামুল উম্মাহ ফাউন্ডেশনের প্রচার সম্পাদক মাওলানা এহসান সিরাজ বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ কমে গেলেও ইকরামুল উম্মাহর ত্রাণ কার্যক্রম চলছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরার আশাশুনি থানার প্রতাপনগরে কয়েক দফা ত্রাণ দিয়েছি। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নারী-পুরুষের জন্য আলাদা টয়লেট এবং গোসলখানা করে দেওয়াসহ বেশ কিছু পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতাও দেওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে মসজিদের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত-নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার জন্য ফান্ড গঠন করা হয়েছিল। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।’
ইকরামুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, ফাউন্ডেশনের থানা এবং জেলা মিলিয়ে প্রায় ৭০টি টিম গঠন করা হয়েছিল। যার অনেকগুলো টিমের কার্যক্রম আর্থিক কারণে বন্ধ হলেও কিছু-কিছু টিমের কার্যক্রম এখনও চলমান। তবে ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাট জেলাসহ থানা টিমগুলো নানামুখী সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান এহসান সিরাজ।
করোনাকালে বেদে সম্প্রদায়কে খাবার, টিউবওয়েল স্থাপন সহযোগিতা দিয়েছে ঢাকা ও বাইরের আলেমদের সমন্বয়ে গঠিত ‘আন নূর হেল্পিং হ্যান্ড বাংলাদেশ। মুন্সীগঞ্জের খাসমহল, বালুচর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুর বেদেপল্লীতে খাবার বিতরণ করে সংগঠনটি।
আন-নূর হেল্পিং হ্যান্ড বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মাওলানা আনসারুল হক ইমরান বলেন, ‘বেদে সম্প্রদায় সমাজে অবহেলিত, নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত। আমরা তাদের খাদ্য, শিক্ষা, সুপেয় পানি, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সেবা নিয়ে কাজ করছি। ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কাজ করেছি। বেদে শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের জন্য আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দ্রুতই তা বাস্তবায়ন করা হবে। বেদেপল্লীর সরদারদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুরের বেদেপল্লীর সদস্য সোরাফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়েকজন আলেম এসে আমাদের খাবার-দাবার, টিউবয়েল দিয়েছেন। তারা আমাদের ঘর করে দেবেন বলে বলেছেন। অবশ্য যদি মালিক জমি দেয়।’
আনছারুল হক ইমরান জানান, ‘আমাদের অর্থনৈতিক সংস্থানের তেমন কোনও উৎস নেই। প্রথমে নিজেরাই শুরু করেছিলাম। পরে কিছু মানুষ এগিয়ে আসে এবং তাদের থেকেও আমরা কিছু সাপোর্ট পাচ্ছি। এভাবেই কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে।’
ঢাকার একাধিক দায়িত্বশীল আলেম বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ঢাকাসহ চট্টগ্রামের নানুপুর, যশোর, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, নোয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, পটিয়া, টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, শেরপুর, ঠাকুরগাঁও, নাটোর, নেত্রকোনা, রাজবাড়ী, রংপুর, জামালপুর, লালমনিরহাট, নরসিংদী, মাদারীপুর, দিনাজপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায়ও আলেমরা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে সম্পৃক্ত। তবে ইতোমধ্যে কোনও কোনও এলাকায় অর্থাভাবে সহযোগিতামূলক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, নতুন করে কোনও সংগঠনকে সরকারি রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে কোনও বার্তা আসেনি।