X
শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২

বিশেষায়িত হাসপাতাল এড়িয়ে চলছেন রোগীরা!

জাকিয়া আহমেদ
২৪ আগস্ট ২০২০, ১৯:৪০আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২০, ১৪:২৯






করোনা পরীক্ষার জন্য স্যাম্পল সংগ্রহ করা হচ্ছে হাসপাতালে দেশে গত ৮ মার্চ থেকে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগী নিয়ে বিপাকে পড়ে হাসপাতালগুলো। শুরুতে কোভিড রোগীদের জন্য হাসপাতাল নির্ধারিত করে দেওয়া হলেও সাধারণ রোগীদের নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হতে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এমনও হয়েছে, হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেছেন রোগী।

ধীরে ধীরে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি সরকারি নির্দেশে অনেক হাসপাতালে একই সঙ্গে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগী ভর্তি শুরু হয়। তাতে অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীরাও হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করেছে। হাসপাতালগুলো পুনরায় রোগী পেতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। তবে কিছু কিছু বিশেষায়িত হাসপাতাল তথা ইনস্টিটিউটকে কোভিড ডেডিকেটেড করায় সেসব হাসপাতালের রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। সেসব হাসপাতালে তারা চিকিৎসা নিতে পারছেন না বলেও জানা গেছে।
করোনার শুরুতে যে ভোগান্তি শুরু হয়েছিল তার সঙ্গে করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেট যোগ হওয়ায় এই ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। আর যার কারণে একেবারেই গুরুতর অসুস্থ না হলে রোগীরা হাসপাতালমুখী হচ্ছেন না।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২৩ আগস্টের তথ্যমতে, সারা দেশে এখন কোভিড রোগীদের জন্য হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ১৫ হাজার ২৫৫টি, আর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) রয়েছে ৫৪৫টি। সারা দেশে কোভিড রোগী ভর্তি রয়েছেন চার হাজার ২৪৮ জন, শয্যা খালি রয়েছে ১১ হাজার সাতটি। আর আইসিইউতে রোগী ভর্তি রয়েছেন ৩৩৫ জন, শয্যা খালি রয়েছে ২১০টি।
কোভিড হাসপাতালের শয্যা খালি থাকায় বেশ কিছু কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, এজন্য হাসপাতালের তালিকা করা হচ্ছে। প্রথমে রাজধানী ঢাকা, পরে পুরো দেশে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। যদিও এই নিয়ে বিশেষজ্ঞরা পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন।
রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা নিতে টাঙ্গাইল থেকে আসতেন ৫৩ বছরের আব্দুল হাকিম মৃধা। করোনা শুরুর পর যখন এই হাসপাতালকে সম্পূর্ণভাবে কোভিড রোগীদের জন্য ঘোষণা করা হয় তখন থেকে আব্দুল হাকিমের চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে।
মোবাইল ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সাধ্যের ভেতরে থাকা বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম, কিন্তু কোনও ডাক্তার দেখাতে পারিনি। তারা রোগী দেখছেন না। একটা পরীক্ষা করানো দরকার গত তিন মাস ধরে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যে পরীক্ষা করাবো সে ভরসা পাচ্ছি না।’
এই হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, কোভিড রোগীরা এখানে ভর্তি। আবার অন্য হাসপাতালে গেলে তাকে প্রথমে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। সে পরীক্ষাতে ভোগান্তি, রিপোর্ট পেতে ভোগান্তি, আবার করোনা পরীক্ষা ছাড়া রোগী ভর্তি নেবে না, সবকিছু মিলিয়ে খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থা।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘কুর্মিটোলাতে আগে বহির্বিভাগে প্রতিদিন ক্যানসার আক্রান্ত রোগী দেখতাম ৭০ থেকে ৮০ জন আর ইনডোরে রোগী ভর্তি থাকতেন ২৫ থেকে ৩০ জন, এখন একজনও নেই। এর অর্থ হচ্ছে, বিশেষায়িত যেসব হাসপাতালগুলোকে কোভিড ডেডিকেটেড করা হয়েছে, সে হাসপাতালের রোগীরা চিকিৎসা নিতে ভোগান্তিতে পড়েছে বেশি। একইসঙ্গে এই হাসপাতালে কিডনি জটিলতায় ভোগা যেসব রোগীদের ডায়ালাইসিস হতো তারাও তো আসতে পারছেন না এখানে। এসব সার্ভিস যে বন্ধ হয়ে গেল তাতে করে রোগীরা ভুগছে।’
রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড করার পর এই হাসপাতালের রোগীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন।
গত ১৬ আগস্ট গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, আগের সেই ভিড় নেই প্রধান ফটকে। এখানে ভর্তি হওয়া কয়েকজন করোনা আক্রান্ত রোগীর স্বজনরা অপেক্ষা করছেন সেখানে। হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে চট্টগ্রাম থেকে আসা এক রোগীর উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘তার চিকিৎসা কেবল এই ইনস্টিটিউটেই করা সম্ভব ছিল। ৫১ বছরের এই রোগী চট্টগ্রাম থেকে এসেও এখানে ভর্তি হতে পারেননি। সারা দিন হাসপাতালের সামনের রাস্তায় বসে ছিলেন। তাকে হাসপাতালের ভেতরে কোথাও বসাতেও পারিনি। যদি তিনি হাসপাতালে ঢুকে সংক্রমিত হয়ে যান সেই ভয়ে।’
গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারি হিসাবে প্রতিদিন দেখছি কোভিড হাসপাতালের শয্যা শূন্য রয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে বিশেষায়িত এসব হাসপাতাল থেকে কোভিড তুলে দেওয়া দরকার। নয়তো আমাদের রোগীরা মারা যাবেন চিকিৎসা না পেয়ে।’
তবে কোভিড এবং নন-কোভিড চিকিৎসা দেওয়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে আশঙ্কাজনক হারে রোগী কমে গেলেও সে চিত্র বদলে গেছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘এখনও এই হাসপাতালে কোভিড রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে। তবে সাধারণ রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি বেড়েছে। এতদিন নন-কোভিড ইউনিটে ইনডোরে ৫০০-এর মতো রোগী হলেও আজ (২৩ আগস্ট) ভর্তি হয়েছে এক হাজারের মতো। আবার বহির্বিভাগে এতদিন ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী থাকলেও এখন সেটা হয়েছে দেড় হাজার।’
সাধারণ রোগীর স্রোত বেড়ে গেছে মন্তব্য করে ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘আগে যে অবস্থা ছিল সেটা এখন আর নাই। এতদিন শয্যা ফাঁকা ছিল, এখন শয্যা পূর্ণ হচ্ছে ধীরে ধীরে।’
একই কথা বলেন রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ উন নবী। রোগী সংখ্যা অনেক বেড়েছে এবং ভর্তি রোগী প্রায় ৮০০-এর মতো থাকছে জানিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বহির্বিভাগ এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে রোগী আসছে ২ হাজার এর বেশি, প্রায় আড়াই হাজারের কাছাকাছি। করোনার শুরুতে রোগী সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল, কিন্তু এখন আর রোগীরা যাবেন কোথায়। রোগের চিকিৎসাতো করাতে হবে, আর কতদিন ঘরে বসে থাকবেন। তখন ভয় ছিল, এখন সে ভয় অনেকটা কেটেছে। তাই হাসপাতালে রোগীরা আবার আগের মতো আসতে শুরু করেছে। এতে করে ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসকরা খুশি।’
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেহেতু সবকিছু এখনও স্বাভাবিক হয়নি, সেহেতু অনেক কিছুই অস্বাভাবিক-এটাই হবে। সবকিছু স্বাভাবিক না হলে স্বাভাবিক আশা করাও যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘মুগদা হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মতো হাসপাতালগুলোকে স্বাভাবিক পর্যায়ে যেতে একটু সময় লাগবে। একইসঙ্গে রোগীরা নিজেরাও হাসপাতালে যাচ্ছে না, সেখানে সংক্রমিত হওয়ার ভয় রয়েছে। রাস্তায় এখন অনেক মানুষ। কিন্তু মার্চের আগে যে মানুষ বের হতো, সে পরিমাণ লোক তো এখনও বের হয়নি। তাই সবকিছু এখনও স্বাভাবিক হয়নি, তার প্রভাব তো নিশ্চয়ই হাসপাতালগুলোতেও রয়েছে।’

/এনএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিভাজন বড় বাধা: ঢাবি উপাচার্য
এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিভাজন বড় বাধা: ঢাবি উপাচার্য
ভারত এক ফ্যাসিস্টকে জায়গা দিয়ে নিজেকেও ফ্যাসিস্ট প্রমাণ করেছে: দুদু
ভারত এক ফ্যাসিস্টকে জায়গা দিয়ে নিজেকেও ফ্যাসিস্ট প্রমাণ করেছে: দুদু
প্রশাসনে বৈষম্যের অভিযোগে কর্মচারী ঐক্য ফোরামের হুঁশিয়ারি
প্রশাসনে বৈষম্যের অভিযোগে কর্মচারী ঐক্য ফোরামের হুঁশিয়ারি
হিন্দু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় হত্যা : বাংলাদেশকে আবারও সতর্ক করলো ভারত
হিন্দু নেতা ভবেশ চন্দ্র রায় হত্যা : বাংলাদেশকে আবারও সতর্ক করলো ভারত
সর্বাধিক পঠিত
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
এক সংবাদ একই শিরোনামে ১৩ পত্রিকায়, সম্পাদকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
‘বাবা বাইরে মা ঘুমিয়ে’, দুই শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা করলো দুর্বৃত্তরা
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
মগবাজার রেললাইনে বাস আটকে যাওয়া সম্পর্কে যা জানা গেলো
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
রাজধানীতে আবার আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল
মৃত্যুর আগে ফেসবুকে লিখলেন ‘ওরা মানুষকে মানুষ মনে করে না’
মৃত্যুর আগে ফেসবুকে লিখলেন ‘ওরা মানুষকে মানুষ মনে করে না’