অনৈতিক লেনদেন এবং অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে আস্তানা গেড়ে বসে আছে দেশের বিচারাঙ্গনে। এর ফলে নৈতিক পথে চলতে থাকা আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদেরও বাধ্য হয়ে অবৈধ লেনদেনে জড়াতে হচ্ছে। নয়তো মামলার ভবিষ্যৎ ভাগ্য ঝুলে যাচ্ছে বছরের পর বছর। তবে বিচারাঙ্গনের দীর্ঘদিনের এই অনৈতিক লেনদেনের রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে আসতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
সুপ্রিম কোর্টে চলমান দুর্নীতি, অনিয়ম ও নানা ধরনের অসঙ্গতি নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে (বার) গত ৮ আগস্ট একটি আবেদন জানিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের দুর্নীতিবিরোধী সাধারণ আইনজীবীরা। ওই আবেদনটি বিবেচনায় নিয়ে এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা করেন বার নেতারা।
ওই আলোচনায় কোর্টে দুর্নীতি-অনিয়মে যুক্তদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দাখিলের আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতির ওই আহ্বানের ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টে দুর্নীতিবিরোধী বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে কোর্ট প্রশাসন।
এরপর দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সামনে গত ৯ আগস্ট একটি অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা হয়। অভিযুক্তদের বিষয়ে নাম, পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ওই অভিযোগ বাক্সে আদালতের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়ে অভিযোগ দিতে বলা হয়।
এদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোর্ট প্রশাসনের কার্যক্রমও পরিকল্পনা মাফিক এগোতে থাকে। যার অংশ হিসেবে রবিবার (১৬ আগস্ট) সুপ্রিম কোর্টের এফিডেভিট শাখার ২ নম্বর প্রশাসনিক ভবনে ঝটিকা অভিযান চালান সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর এবং পুলিশ সদস্যদের নিয়ে বিচারপতি এ অভিযান পরিচালনা করেন।
জানা গেছে, আগে আইনজীবীদের ক্লার্ক বা পিয়নরা নিজেরা বিভিন্ন শাখায় গিয়ে মামলার ফাইলের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতো। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন শাখার দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধে কোর্ট প্রশাসন মামলার এফিডেভিটের বিষয়ে টোকেন পদ্ধতিসহ অন্যান্য নতুন নিয়ম চালু করে। ফলে বর্তমানে মামলার ফাইল জমা দিয়ে ভবনের বাইরে অবস্থান করার এবং সকল প্রক্রিয়া শেষে ফাইলটি যথাযথ ক্লার্ক বা পিয়নকে হস্তান্তরের নিয়ম চালু হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আইনজীবী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মামলার ফাইল জমা থাকা কিংবা আদেশের অনুলিপি না পাওয়ায় আইনজীবীদের ক্লার্কদের কেউ কেউ আজ সেসব ফাইল খুঁজতে শাখায় গিয়েছিল। আবার কেউ কেউ বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে নিয়ে এফিডেভিট শাখায় মামলার এফিডেভিট করতেও এসেছিলেন। ফলে করোনা পরিস্থিতিতে সেখানে বেশ ভিড় জমে যায়। আর ঠিক এমন সময়েই বিচারপতি তার অভিযান পরিচালনা করতে শাখায় প্রবেশ করেন এবং শাখায় অতিরিক্ত লোকের উপস্থিতি দেখে তাদের আটকের নির্দেশ দেওয়া হয়। কেননা, নতুন নিয়মের শাখার ভেতরে কারও অবস্থানের সুযোগ ছিল না। তারপরও যারা অবস্থান করছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই আইনজীবীদের ক্লার্ক ও মক্কেল, যারা কিনা মামলার ফাইল ও আদেশ সংগ্রহ এবং এফিডেভিট করতে গিয়েছিলেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে অনেক ক্লার্ক তাদের আইডি কার্ড দেখাতে পারেনি। যার কারণে তাদের আটকের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর সেখানে আটকে পড়া ক্লার্ক ও বিচারপ্রার্থীরা তাদের সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে বিষয়টি অবহিত করেন। একইসঙ্গে তাদের আইনজীবী ও কোর্ট প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দকে বিষয়টি অবহিত করে এবং তাদের ঘটনাস্থলে ডাকা হয়। ’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনজীবীরা আরও বলেন, ‘এ সময় সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলের নেতৃত্বে সমিতির অন্যান্য নেতা ঘটনাস্থলে গিয়ে হাজির হন এবং সার্বিক বিষয়ে অবহিত হন। এরপর আইনজীবী নেতৃবৃন্দ আটক ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান। তারা যেহেতু আইনজীবীদের ক্লার্ক, তাই তাদের বিরুদ্ধে শাখায় প্রবেশের অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও সেখানে প্রবেশের বিষয়ে আইনজীবী সমিতি ব্যবস্থা নেবে বলে জানানো হয়। পরে পুলিশ সদস্যরা আটক ব্যক্তিদের ছেড়ে দেন।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মশিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ক্লার্করা যেহেতু আইনজীবীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো। আজকের ঘটনায় কোনও দুর্নীতি বা লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে ভবনের ভেতরে অবস্থান না করার শর্ত থাকলেও অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থান করায় তাদের ওই আটকের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে সেজন্য আমরা ক্লার্কদের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়েছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বিশৃঙ্খলার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্ট এফিডেভিট শাখায় ঝটিকা অভিযানকে সাধুবাদ জানাই। মাঝে মাঝেই এমন অভিযান চালানো উচিত বলেও মনে করেন তিনি।