দেশে এলে জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত গাড়িতে চলাফেরা করতো অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা সেলিম প্রধান। তার তিনটি গাড়িতেই ছিল সংসদের স্টিকার লাগানো। সেলিম প্রধান সংসদ সদস্য না হয়েও কীভাবে স্টিকার পেতো, তা খুঁজে দেখছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনোর স্রষ্টা সেলিম প্রধান সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) গ্রেফতারের পর বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এরইমধ্যে তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এবং মানি লন্ডারিং আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। র্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, তাকে এই দুই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
সেলিম প্রধানের গাড়িতে জাতীয় সংসদের স্টিকার
এ পর্যন্ত সেলিম প্রধানের ছয়টি গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে, রয়েছে তিন জন ব্যক্তিগত গাড়িচালক। তার বাসার গ্যারেজে নিশান পেট্রোল কালো রঙের গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১১-২১৬৫) সংসদের স্টিকার লাগানো ছিল। জাতীয় সংসদের সদস্যরা নিজের গাড়ির জন্য একটি করে স্টিকার পেয়ে থাকেন, যা তাদের গাড়িতে লাগাতে পারেন। সেলিম প্রধান গাড়িতে চলাচলের সময় উচ্চশব্দে হুটার বাজানো হয়। ভিআইপি প্রটোকলের মতো তার গাড়িবহরের সামনে-পেছনে থাকতো পাঁচ-ছয়টি দামি গাড়ি।
থাইল্যান্ডে প্রভাবশালীদের জন্য বিনোদন ও অনৈতিক সুবিধা
সেলিম প্রধান দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে বসবাস করেছে। সেখানে তার বাড়িও রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনীতিক ও আমলা থাইল্যান্ডে গেলে সেলিম তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা করতো। এভাবেই দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। এরপর সে দেশে ক্যাসিনো ও স্পা ব্যবসা করার পথ সুগম করে। জানা গেছে, থাইল্যান্ডে তার একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন রয়েছে। পাতায়া শহরেও ‘প্রধান স্পা’ নামে একাধিক বিউটি সেন্টার রয়েছে তার।
বিএনপি আমলে সেলিমের উত্থান
তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সেলিম প্রধানের বন্ধুত্ব রয়েছে। বিএনপি আমলে জাপানিদের অর্থায়নে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলে সেলিম। ওইসময় এই প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রায় সব ব্যাংকের চেক বইসহ ব্যাংকিং দলিলপত্র ছাপানো হতো। এই প্রিন্টিং ব্যবসার নামে সে রূপালী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সে একটি গাড়িও উপহার দেয়। এমনকি অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ লন্ডনে পাঠানো হতো বলে জানিয়েছে র্যাব-১ এর অধিনায়ক সারোয়ার বিন কাশেম। র্যাবের দাবি, সেলিম প্রধানের বিপুল অঙ্কের অর্থ রয়েছে থাইল্যান্ডে।
অপরাধ করে জাপান থেকে বহিষ্কৃত
সেলিম প্রধানের জন্ম ঢাকায় ১৯৭৩ সালে। ১৯৮৮ সালে তার ভাইয়ের সঙ্গে জাপানে যায় সে। সেখানে তারা গাড়ির ব্যবসা করতো। পরবর্তীতে অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়ালে জাপান সরকার সেলিমকে সেদেশ থেকে বহিষ্কার করে। এরপর সে থাইল্যান্ডে চলে আসে। সেখানে শুরু করে শিপইয়ার্ডের ব্যবসা। থাইল্যান্ডেই তার পরিচয় হয় কোরিয়ান নাগরিক মিস্টার তু’র সঙ্গে। এরপর জড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক জুয়াড়ি চক্রের সঙ্গে। শুরু করে স্পা ও ক্যাসিনো ব্যবসা। বিভিন্ন ক্লাবে তার যাতায়াত শুরু হয়। ২০১৫ সালে সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের তদন্ত শুরু হয়। সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য উঠে আসে। এরপরই মূলত কোণঠাসা হয়ে পড়ে থাই পাসপোর্টধারী সেলিম প্রধান।
একাধিক দেশে একাধিক বিয়ে
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা এলাকার সেলিম প্রধান আন্তর্জাতিক মহলে ধীরে ধীরে মাফিয়া হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ, জাপান ও রাশিয়ায় রয়েছে তার তিন স্ত্রী ও একাধিক সন্তান।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও মুদ্রাপাচার আইনে মামলা
অনলাইন ক্যাসিনোর মূলহোতা সেলিম প্রধানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে তিন জন উত্তর কোরিয়ার নাগরিক। এছাড়া, সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেও মামলা হয়েছে।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিমানবন্দর থেকে সেলিম প্রধান গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে নিয়ে মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) দিনে ও রাতে তার গুলশান-বনানীর অফিস ও বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা, মাদক ও নগদ অর্থ জব্দ করা হয়। এছাড়া, হরিণের দুটি চামড়াও জব্দ করা হয়েছে।
হরিণ হত্যার দায়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের ভ্রাম্যমাণ আদালত সেলিম প্রধানকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দুই মামলায় বুধবার (২ অক্টোবর) তার রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত রিমান্ড শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করেন।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে মানি লন্ডারিং হয়েছে। এই ব্যবসার সঙ্গে বিদেশি নাগরিকদেরও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে সেলিম প্রধান তা স্বীকারও করেছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। তদন্তে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।’