প্রাকৃতিক ও ঘরে বানানোর নামে বাজার সয়লাব অনুমোদনহীন পণ্যে। প্যাকেট বা বোতলজাত করে দোকান খুলে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে, অথচ এসব প্যাকেট বা বোতলের গায়ে ‘লেবেল’ নেই। এটাকে ফাঁকি বলছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটি বলছে, এসব পণ্য যেমন অবৈধ, তেমনি জনস্বাস্থ্যের জন্যও তা বিপজ্জনক হতে পারে।
ভোক্তা অধিকার অভিযান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা এসব ব্যাপারে অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিতে পারেন। যেসব পণ্যে বাধ্যতামূলক অনুমোদন থাকার কথা, সেগুলোতে অনুমোদন না নেওয়া অপরাধ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন চকলেট, আচারে বিদেশি নামিদামি ব্যান্ডের লেবেল লাগিয়ে বাজারজাতকরণ, পণ্যের গায়ে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ না থাকাসহ নানা অনিয়মে বিএসটিআই-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করে থাকেন। গত এপ্রিলে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারীকে জেল-জরিমানা করা হয়।
তবে বাজারে এমন অনেক পণ্য বিক্রি হচ্ছে যেগুলোর কোনও অনুমোদন নেই। নিয়মানুযায়ী, বিএসটিআই-এর বাধ্যতামূলক ১৮১টি পণ্যের তালিকার মধ্যে পড়লেই অনুমোদন নিতে হবে। এ তালিকার মধ্যে ঘি, মধু, মুড়ি, আচার জাতীয় পণ্যও রয়েছে।
বিএসটিআই বলছে, এর যেকোনও একটি বাজারজাত করতে হলে অনুমোদন লাগবে। তা না হলে সেগুলো অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। এবং এসব পণ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনকও হতে পারে।
অনলাইনেও এমন অনেক দোকার আছে যারা বিএসটিআই-এর অনুমোদনহীন পণ্য বিক্রি করছে। এসব পণ্যের দামও তুলনামূলক বেশি। প্রাকৃতিক ও বিভিন্ন এলাকার বিখ্যাত যেসব পণ্য রাজধানীর মানুষকে দেওয়ার কথা বলা হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেসবের মান ভীষণ খারাপ বলে অভিযোগ আছে ক্রেতাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্রেতা জানান, শীতের শেষে অনলাইন থেকে পাটালি গুড় কেনেন তিনি পরিচিত এক ব্যক্তির কাছ থেকে। বাসায় ডেলিভারি পাওয়ার পর প্যাকেট খুলে দেখেন গুড় নষ্ট। তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এ ধরনের ব্যবসা যতটা সম্ভব স্বচ্ছতার সঙ্গে করা উচিত। কেননা, পণ্যের মান মনিটর করার কেউ নেই। সেক্ষেত্রে নিজেদেরই সতর্ক থাকার বিষয় আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে প্রাকৃতিক কৃষিপণ্য ও ঘরে বানানো পণ্য কেনায় একশ্রেণির ক্রেতা তৈরি হয়েছে। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের আস্থাও পেতে শুরু করেছে।
প্রাকৃতিক কৃষি নিয়ে কাজ করছেন দেলোয়ার জাহান। তিনি মনে করেন, কৃষককে সরাসরি বাজারে ঢুকতে না দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা এই অনুমোদন। কৃষককে সরিষাই বিক্রি করতে হবে। তেল বাজারে আনার যে প্রক্রিয়া, সেটা তার পক্ষে সম্পাদন করে বাজারে নামা সম্ভব নয়।
দেলোয়ার জাহান বলেন, ‘রাজধানীতে এ ধরনের যে বিক্রেতারা আছেন, তারা কোনও ব্র্যান্ড ব্যবহার করছেন না। ফলে তাদের অনুমোদন লাগবে না।’ এটা একেবারেই খোলা বিক্রির মতো বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএসটিআই-এর পরিচালক প্রকৌশলী এস এম ইসহাক আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে ১৮১টি পণ্যের তালিকা বিএসটিআই-এর ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে সেগুলোর যেকোনও একটি বিক্রি করতে চাইলে আমাদের অনুমোদন লাগবে।’
অনুমোদন না নিয়ে যারা পণ্য বিক্রি করছেন তাদের বিষয়ে বিএসটিআই ব্যবস্থা নিতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় আইনি কিছু জটিলতা ছিল। মে মাসে সেই জটিলতা কেটে গেছে। এখন বিএসটিআই এই আদালত পরিচালনার মধ্য দিয়ে বেআইনি বিক্রেতাদের ধরতে পারবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে আমরা এ ধরনের বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে পারি।’
অভিযোগ পাওয়ামাত্র ব্যবস্থা নেওয়া হবে উল্লেখ করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাসুম আরেফিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এভাবে বিক্রির কোনও অনুমতি নেই। আমাদের নিজেদের খুঁজে বের করা কঠিন। যদি এ ধরনের দোকানের খবর কেউ দেন, তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। নিয়ম না মেনে এ ধরনের জিনিস বিক্রি বেআইনি। ক্রেতাদেরও সচেতন হওয়া জরুরি।’
সম্প্রতি মানহীন পণ্য নিয়ে আইনি লড়াইয়ে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেসব পণ্য প্যাকেটজাত করা সম্ভব সেগুলো এখানে অনুমোদন ছাড়া বিক্রি বেআইনি। বাংলাদেশ স্ট্রান্ডার্ড ওজন আইনে মোড়কসংক্রান্ত বিধিমালায় সুনির্দিষ্ট করে বলা আছে: মোড়ক তো লাগবেই, সঙ্গে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, উৎপাদন তারিখ ও মেয়াদ তারিখ থাকতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা ঘরে বানানো বা প্রাকৃতিক নানা পণ্যের কথা বলছেন, সেই ব্যবসায়ীরা ফাঁকিটাই এখানে রাখছেন মোড়ক দেওয়া না-দেওয়ায়। সেক্ষেত্রে আইনিভাবে তাদের ধরার যথেষ্ট সুযোগ আছে। নিয়মিত বাজার মনিটর করে এসব দোকান ও অনলাইনের তালিকা করা দরকার। যাতে ভোক্তারা কোনও বিপদের মুখে না পড়েন।’