X
সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
১৫ বৈশাখ ১৪৩২

সৌদি আরবের ক্যাম্পগুলোতে নারী শ্রমিকদের নির্যাতনে জড়িত কারা

সাদ্দিফ অভি
০৭ জুলাই ২০১৮, ২৩:১১আপডেট : ০৮ জুলাই ২০১৮, ১১:৩০

 



বিমানবন্দরে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা এক নারী শ্রমিক (ফাইল ছবি) আর্থিক সচ্ছলতার জন্য সৌদি আরব গিয়েও স্বস্তি মিলছে না নারী শ্রমিকদের। নির্যাতন-নিপীড়ন সইয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার চেয়ে খালি হাতে ফিরে আসাকেই তাই শ্রেয় মনে করছেন অনেকে। ফিরে বলছেন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। সৌদি আরবের বিভিন্ন ক্যাম্পে নারী শ্রমিকদের ওপর চালানো পাশবিক নির্যাতনের কথার সূত্রে বেরিয়ে আসছে কাদের ইন্ধনে এসব ক্যাম্প পরিচালিত হয়, কারা নির্যাতনের হোতা।



খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেদ্দা ও রিয়াদসহ সৌদি আরবের বিভিন্ন শহরে এরকম ক্যাম্প আছে কয়েকশ’। প্রায় প্রতিটা ক্যাম্পের সঙ্গেই বাংলাদেশিরা জড়িত আছে। তারা কাজ করে সৌদির রিক্রুটিং এজেন্টের দালাল হিসেবে। এই দালালরা একজন নারী শ্রমিককে একাধিক ক্রেতার সঙ্গে লেনদেনের কাজ করে। তাদের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে অফিসও। নিয়োগকর্তা কিংবা ক্রেতার কাছ থেকে অভিযোগ আসামাত্র এসব অফিসে নারী শ্রমিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। ইলেকট্রিক শক দেওয়া থেকে শুরু করে লোহার রড গরম করে ছ্যাকা দেওয়া হয়। দালালের কথা না শুনলে অত্যাচারের পর বেচে দেওয়া হয় অন্য ক্রেতার কাছে।
জানা গেছে, এসব ক্যাম্পের অনেকেই নারী। এমন এক নারীর নামও জানা গেছে— সালমা। রিয়াদে সালমার অফিসে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে দেশে ফিরেছেন হবিগঞ্জের আয়শা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘সালমা নামের ওই মহিলা চালায় সেই অফিস। সেখানে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়।লোহার রড গরম করে ছ্যাকা দেওয়া হয়। লাঠি দিয়ে ইচ্ছামতো সে মারে।’
সৌদি আরবে চুক্তি শেষ হওয়ার আগে দেশে ফেরা নির্যাতিত নারী শ্রমিকদের জন্য খুব কঠিন। যারা নিয়োগকর্তার কাছ থেকে পালিয়ে আসেন তাদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দেওয়া হলে ভিসা ‘ডিজিটালি লক’ করে দেওয়া হয়। ফলে ইমিগ্রেশনে ধরা পড়ে তারা এবং পাঠিয়ে দেওয়া হয় সফর জেলে বা ডিপোর্টিং সেন্টারে। সেখানে তাদের ফেলে রাখা হয় মাসের পর মাস। সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো অভিযোগ নিষ্পত্তি। এসব ডিপোর্টিং সেন্টারেও নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারী শ্রমিকদের।
প্রবাসে কর্মরত নারীদের ওপর চলা নির্যাতন-হয়রানি থেকে রেহাই দিতে, নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় তাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ‘সেফ হোম’ স্থাপন করা হয়েছে। ওয়েজ আরনারস কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে তৈরি এসব সেফ হোম বাংলাদেশ মিশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করা হয়। সেফ হোমে আশ্রয় নেওয়া নারীদের খাবার, চিকিৎসাসহ সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়। সৌদি আরবের রিয়াদে একটি, জেদ্দায় দুটি, ওমান ও লেবাননে একটি করে সেফ হোম রয়েছে। এসব সেফ হোমের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি নারী শ্রমিক প্রতিদিন এসে জড়ো হচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সৌদি আরব থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন নাসিমা আক্তার (ছদ্মনাম)। অনেক স্বপ্ন নিয়ে, অনেক আশায় বুক বেঁধে দালালের মাধ্যমে কাজের আশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন নতুন একটি দেশে। এজন্য দালালকে দিতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। চুক্তি হয়েছিল ৮০ হাজার টাকার। বাকি টাকা কাজে যোগ দিয়ে মাসিক বেতন এক হাজার রিয়াল থেকে দেওয়া হবে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বুঝে নিয়ে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গত ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরব যান। জেদ্দা এয়ারপোর্টে নামার পর রিক্রুটিং এজেন্সির লোক তাকে একটি বাড়িতে রাখে। চারদিক বন্ধ এই বাড়িকে বলা হয় ক্যাম্প। সেখানে তার সঙ্গে আরও কয়েকজন বাংলাদেশি নারী শ্রমিকের দেখা হয়। তাদের কাছে জানতে পারেন পাশবিক নির্যাতনের কথা। পাঁচ দিন পর নাসিমাকে পৌঁছে দেওয়া হয় তার নিয়োগকর্তার বাড়িতে। ছোট পরিবারের কথা বলে তাকে পাঠানো হলেও সেখানে গিয়ে দেখেন ভিন্ন চিত্র। ১১ সদস্যের পরিবারের রান্না, ঘরদোর মোছা, কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে সবই করতে হবে।
কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও বিশ্রামের সুযোগ নেই। কারণ বিশ্রাম করতে গেলেই কফিল (মালিক) লাঠি দিয়ে মারে।
দেশে ফিরে এভাবেই সৌদির দিনগুলোর বর্ণনা দেন নাসিমা বাংলা ট্রিবিউনের কাছে। বলেন, ‘কফিলের মুখের ভাষা আমি বুঝি না। এজন্য অনেক সমস্যা হইতো। খাবার দিতো না ঠিক মতো, আবার অসুস্থ হইলে চিকিৎসা করাইতো না। সেখান থেকে পালায় গেসিলাম। কিন্তু আমারে রাস্তায় পাইয়া ধইরা নিয়া গেসে দালালের লোক। আমারে ক্যাম্পে আটকায় রাখসে সাত দিন। মারসে অনেক, হাত দিয়াই মারসে কানের বরাবর। সেখান থেকে বাড়িতে ফোন কইরা বাকি টাকার জন্য বলসি। আমার এই দিক সেদিক কইরা জোগাড় কইরা টাকা দিসে।’
একইভাবে সৌদি ফেরত নারী শ্রমিক সুমাইয়া কাজল (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পেও নির্যাতন করা হয়েছে। ক্যাম্পের ভেতরে উগান্ডার মেয়েদের পাহারায় বসিয়ে রাখতো। আমরা দেশে আসতে চাইলে মারধর করতো। লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে অনেককে। পিংকির মাজায় লাঠি দিয়ে মেরেছে ট্রাভেল এজেন্সির দালালদের নিয়োগ দেওয়া উগান্ডার এক নারী।’
সুমাইয়া অভিযোগ করে বলেন, ‘আল মনসুর ওভারসিজ অ্যান্ড ট্রাভেলস সৌদি আরবে মানুষ পাঠায়। সেখানে ট্রাভেলস এজেন্সিগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্যাম্পে রাখা হয় বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের। এরপর আকামা কার্ড (শ্রমিক পরিচিতি কার্ড) পাওয়ার পর এক মালিকের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। সেখানে তিনতলা বাসা পরিষ্কার, ধোয়া-মোছার কাজ করতে হতো। থালাবাসন ধুয়ে পরিষ্কার করাসহ যখন যে কাজে বলেছে, কোনও কথা না বলে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করতে হয়েছে। দুই দিন কাজ করার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে আল খোবার এলাকার একটি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’
এসব ক্যাম্পের বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায় না কেন? এমন প্রশ্নে জেদ্দা ও রিয়াদে অবস্থিত শ্রম উইংয়ের কাউন্সিলররা কোনও সাড়া দেননি। এমনকি ইমেইলে জানতে চেয়েও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে নাম গোপন রাখার শর্তে দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানান, এসব অভিযোগের বিষয়ে আমলে নেওয়া খুব দুরূহ ব্যাপার। কারণ, অভিযোগ করার পর অভিযোগকারীকে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এদেশে অবস্থান করতে হয়, যা একটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। বর্তমানে অনেক নারী শ্রমিকই নিয়োগকর্তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে আটকা পড়ে আছেন। অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দেশে ফিরতে পারবেন না। এসব অভিযোগ নিষ্পত্তি হওয়ার প্রক্রিয়া একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই অনেকেই ঝামেলা পোহাতে চায় না।’
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘এরকম কয়টি ক্যাম্প আছে, বলা মুশকিল। এসব ক্যাম্পের সঙ্গে যুক্ত থাকেন সৌদি আরবের নিয়োগকর্তারা। এসব ক্যাম্পেও নারী শ্রমিকদের নির্যাতন করা হয় বলে বিভিন্ন সময়ে ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি।’
নিজের তথা পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করতে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশের অনেক নারী শ্রমিক পাড়ি জমান সৌদি আরব, আরব-আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবাননসহ বিশ্বের অন্তত ১৮টি দেশে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালে অভিবাসী নারীর সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ৯২৫ জন, যা মোট অভিবাসন সংখ্যার ১৩ শতাংশ।
১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত একা কোনও নারী শ্রমিককে অভিবাসনে বাধা দেওয়া হলেও ২০০৩ এবং ২০০৬ সালে কিছুটা শিথিল করা হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নারী শ্রমিকের অভিবাসন হার বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় মোট অভিবাসনের ১৯ শতাংশে। যদিও এ হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি নারী শ্রমিক যান। আবার নানা কারণে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগে সেখান থেকেই সবচেয়ে বেশি নারী দেশে ফেরত আসেন। তবে কোনও সংস্থা কিংবা মন্ত্রণালয়, কারও কাছে ফেরত আসা নারী শ্রমিকের বিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য নেই।
বিমানবন্দরের প্রবাস কল্যাণ ডেস্ক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ মে ৩৫ জন, ১২ মে ২৭ জন, ১৯ মে ৬৬ জন, ২৩ মে ২১ জন, ২৭ মে ৪০ জন এবং ৩ জুন ২৯ জন, ১৮ জুন ১৬ জন এবং ১৯ জুন ২৭ জন এবং ২৬ জুন ২২ জন নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। তবে এর বাইরে আরও নারী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন বলে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়।

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দক্ষিণ বৈরুতে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র মজুদে ইসরায়েলের হামলা
দক্ষিণ বৈরুতে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র মজুদে ইসরায়েলের হামলা
ইউআইইউ বন্ধ ঘোষণা
ইউআইইউ বন্ধ ঘোষণা
আব্বাস, কেলিদের নিয়ে বাংলাদেশে আসছে নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দল
আব্বাস, কেলিদের নিয়ে বাংলাদেশে আসছে নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দল
শ্যাম্পুর আগে ৩০ মিনিটের যত্নে চুল হবে সিল্কি
শ্যাম্পুর আগে ৩০ মিনিটের যত্নে চুল হবে সিল্কি
সর্বাধিক পঠিত
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নূরজাহানের পদত্যাগ দাবি
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নূরজাহানের পদত্যাগ দাবি
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা, কেড়ে নেওয়া হলো মাইক
মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা, কেড়ে নেওয়া হলো মাইক
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস
শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন মোদি: আল জাজিরাকে ড. ইউনূস