পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট আর বৈশাখী ভাতার দাবি থেকে হঠাৎ করেই জাতীয়করণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন বেসরকারি শিক্ষকরা। এক দফা দাবি নিয়ে ১০ দিন অবস্থান কর্মসূচির পর আমরণ অনশনের কর্মসূচি দেন তারা। সরকারের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের আশ্বাস না পাওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটেরও ডাক দেওয়া হয়। কয়েকদিন আগে শেষ হওয়া এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের এই আন্দোলনের পেছনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অবহেলা আর গাফিলতিই দায়ী বলে জানান শিক্ষক নেতাসহ সংশ্লিষ্টরা।
আন্দোলনকারী শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর করে সরকার। ওই বেতন স্কেল কার্যকর সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে প্রতিবছর পাঁচ শতাংশ হারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনক্রিমেন্ট বেতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা বলা হয়। এরপর থেকে সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষকরা এই সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা এই সুবিধা পান না। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের বৈশাখী ভাতা দেওয়া হবে বলা হলেও গত তিন বছরেও তা দেওয়া হয়নি। আর পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগই নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
স্বাধীনতা শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু জানান, পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট বেতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে বাদ পড়ার পর থেকেই সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। কারণ,হিসেবে তারা বলছেন, দেশের ৯৮ ভাগ শিক্ষককে বাদ দিয়ে মাত্র দুই শতাংশ সরকারি শিক্ষকদের পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
শিক্ষক নেতারা জানান, বারবার দাবি জানালেও এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনও উদ্যোগ না থাকায় ২০১৬ সাল থেকে কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। এরপর দফায় দফায় আন্দোলন কর্মসূচি দিলেও মন্ত্রণালয়ের কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি বৈশাখী ভাতা দেওয়া হয়নি ২০১৭ সালেও। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যোগ করার জন্যও কোনও উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য হয়েই হঠাৎ জাতীয়করণের একদফা দাবিতে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হন শিক্ষকরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক নেতা বলেন, তারা পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতার দাবি তুলেছেন বারবার। এ বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা গুরুত্ব দেননি। তাদের অবহেলা ও গাফিলতির কারণেই বেসরকারি শিক্ষকরা সুযোগ বুঝে হঠাৎ করে জাতীয়করণের দাবিতে মাঠে নেমেছেন।
এ প্রসঙ্গে মো. শাহজাহান আলম সাজু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষকরা আগে থেকে কমবেশি জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসছে। তবে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও বৈশাখী ভাতার দাবির প্রতি গুরুত্ব না দেওয়ায় জাতীয়করণের আন্দোলনটি গুরুত্ব পায়। এছাড়া শিক্ষকদের আর কোনও উপায় ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা জরুরি ছিল। মন্ত্রণালয়ের অবহেলায় শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।’
শিক্ষকদের বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বিত সংগঠন বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের আহ্বায়ক মো. আব্দুল খালেক ও প্রেস সচিব এনামুল ইসলাম মাসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষকরা আমরণ অনশন শুরু করলেও মন্ত্রণালয় কোনও গুরুত্ব দেয়নি। এ কারণে ১৪ দিন অনশনের পর ২৯ জানুয়ারি থেকে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।’ তবে পরে সরকারের আশ্বাসের পর ওইদিনই লাগাতার ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন শিক্ষকরা।
এনামুল ইসলাম মাসুদ আরও বলেন, ‘পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট আর বৈশাখী ভাতার দাবি উপেক্ষা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাই বাধ্য হয়েই আমরা একদফার আন্দোলন শুরু করি। দাবি আদায়ে সব শেষে ধর্মঘটের ডাকও দেওয়া হয়। যদি আগেই পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট আর বৈশাখী ভাতার দাবি মেনে নেওয়া হতো, তাহলে এত দ্রুত হয়তো সব শিক্ষক জাতীয়করণের দাবিতে মাঠে নামতেন না।’ যদিও আগে থেকেই শিক্ষকরা জাতীয়করণের সাধারণ দাবি জানিয়ে আসছিলেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, শিক্ষকরা ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার পর গত ২৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ওই সময়ের রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব মহীউদ্দীন খান অনশনরত শিক্ষকদের অনশন ভাঙান। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা জানালে শিক্ষকরা আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন।
শিক্ষকদের অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাভেদ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষকদের সব ধরনের দাবি আমরা মানার চেষ্টা করছি। সব ধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আর্থিক সুবিধা দিতে হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগে। অনুমোদন না পেলে আমরা কিছু করতে পারি না। শিক্ষকদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কোনও উদ্যোগ নেয় না এই অভিযোগ ঠিক না।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব সালমা জাহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া না হলে অনেক কিছুই দেওয়া যায় না।’
শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কেরামত আলী শিক্ষকদের আন্দোলনের বিষয়ে বলেন, ‘আমরা নীতিমালা ঠিক করে তাদের দাবির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবো। জাতীয়করণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নির্দেশনা দেবেন সেভাবই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’