সারাবিশ্বে বাংলাদেশের মানবপাচার পরিস্থিতি এবং দেশের ভেতরে এ সংক্রান্ত অপরাধ দমনে আইনের সীমিত ব্যবহারের কারণে গত তিন বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার প্রতিবেদনে দ্বিতীয় স্তরের নজরদারির তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। এ বছর পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে বাংলাদেশের তৃতীয় স্তরে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন খোদ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এই প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে সরকার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেশের মানবপাচার পরিস্থিতি এবং সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে একটি প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, জুন মাসে প্রকাশিতব্য যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার প্রতিবেদনে এর প্রতিফলন থাকবে।
তবে একাধিক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, এবারের প্রতিবেদনে দ্বিতীয় স্তরে নজরদারির তালিকায় বাংলাদেশের থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এবার হয় দ্বিতীয় স্তরে উন্নীত হবো, অথবা তৃতীয় স্তরে অবনমিত হবো। অবনমন ঘটলে এর পরিণতি আমাদের জন্য ভালো হবে না। কারণ এর প্রভাব বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়বে।’
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র মানবপাচার রিপোর্টে চারটি ক্যাটাগরিতে দেশগুলোকে ভাগ করে থাকে। সেগুলো হচ্ছে—প্রথম স্তর, দ্বিতীয় স্তর, দ্বিতীয় স্তরের নজরদারি ও তৃতীয় স্তরের নজরদারি।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি কোন অবস্থায় রয়েছে, জানতে চাইলে সরকারের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে—মানবপাচার সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচার না হওয়া।’
প্রসঙ্গত, সরকারের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে মানবপাচার সংক্রান্ত ৬৪৪টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে চারটি মামলা, ১১ জনের যাবজ্জীবন ও তিন জনের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। এর একবছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালে মোট মামলা হয়েছে ৫৪৭টি। এরমধ্যে ৩৪টি নিষ্পত্তি হয়েছে। সাতজনের যাবজ্জীবন এবং একজনের অন্য মেয়াদে শাস্তি হয়েছে। এছাড়া, আগের মামলাসহ ২০১৮ সালে দেশে মানবপাচারের অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৮৫৩টি এবং ২০১৯ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৪৪০টি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘যে হারে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, তার তুলনায় বেশি সংখ্যায় নতুন মামলা যোগ হচ্ছে। ফলে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকছে এবং এর প্রতিফলন দেখা যায় মানবপাচার রিপোর্টে।’
মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল
মানবপাচার সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার বিধান রেখে ২০১২ সালে জাতীয় সংসদে ‘মানবপাচার প্রতিরোধ আইন’ পাস হয়। কিন্তু গত আট বছরেও এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা হয়নি।
এ বিষয়ে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘গত ৪ মার্চ আইনমন্ত্রী (আনিসুল হক) জানিয়েছেন, মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল দ্রুত স্থাপন না করলে, যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার রিপোর্টে আমাদের অবস্থান নেমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’
তিনি বলেন, ‘এমাসের মধ্যেই এই ট্রাইব্যুনালের দৃশ্যমান কার্যক্রম, অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার শুরু করতে হবে। অন্যথায় জুন মাসের রিপোর্টে এর প্রতিফলন (ইতিবাচক) হওয়ার সম্ভাবনা কম।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে সাতটি মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের জন্য সরকার এরইমধ্যে অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেয়েছে। বর্তমানে নারী ও শিশু আদালতে মানবপাচার অপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচার করা হয়।
মানবপাচার
এক শ্রেণির আদম পাচারকারী ও দালালচক্র দেশের অভ্যন্তরে নিরীহ মানুষকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার করে থাকে। বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। জানা গেছে, বাংলাদেশি দালালচক্র বিদেশের মাটিতে মানবপাচারের জন্য র্যাকেট পরিচালনা করছে। মেক্সিকো, ব্রাজিল ও প্যারাগুয়েতে এ ধরনের কয়েকটি র্যাকেটের সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। এসব দেশে র্যাকেট পরিচালনার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশিরা গ্রেফতারও হয়েছে।
এ বিষয়ে সরকারের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘এই বাংলাদেশিরা বিদেশে এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। পাশাপাশি দেশেও তাদের লোকজন সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু দেশে এদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনও অভিযান নেই।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিরা জড়িত থাকায়, প্রতিটি মানবপাচারের ঘটনা বাংলাদেশের অবস্থানকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এগুলো প্রতিরোধে দেশের অভ্যন্তরে দৃশ্যমান উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন। কারণ, উল্লিখিত প্রতিটি দেশ থেকে যে মানবপাচার হতো, তাদের গন্তব্যস্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্র।’